-মাহমুদুল হাসান
এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। বেঙ্গলবুকস সম্পর্কে কথাটি বলা যায়। বইমেলায় এবারই প্রথম অংশগ্রহণ, প্রথমবারেই সেরা স্টলের পুরস্কার অর্জন। এছাড়া গত বছর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণ করছে কিন্ডারবুকস। ‘টু প্রোভাইড বেস্ট কোয়ালিটি কনটেন্ট উইথ কস্ট ইফেক্টিভ ওয়ে’ বেঙ্গলবুকস ও কিন্ডারবুকস-এর মূলমন্ত্র। প্রতিষ্ঠান দু’টি নিয়ে কথা বলেছেন প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসান। তাঁর সাথে আলাপচারিতায় ছিলেন তৌহিদ ইমাম, জাকির উসমান ও নুসরাত নুসিন
খুব উচ্ছুসিত যে পুরস্কারটা…
মাহমুদুল হাসান : আমাদের বাংলাদেশে সকল পাবলিশারের পক্ষে বই সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেটা দরকার, প্রপার ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক। আমাদের প্রকাশনার বয়স ৪০ বছর প্রায়। যে কারণে আমাদের ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কটা শক্তিশালী। এই বইগুলো চাহিদার ওপর দৃষ্টি রেখে ডিস্ট্রিবিউট করতে হয়। খুব কষ্টসাধ্য কাজ এটা। যেহেতু যুগ পরিবর্তন হচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখানে কীভাবে বই ডিস্ট্রিবিউট করা যায়, সেটা ভাবতে হচ্ছে। প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলায় পাঠাগার গড়ে তোলা দরকার। পাঠাগার করতে পারলে বইগুলো ডিস্ট্রিবিউশন করা সহজ হবে। শুধু ঢাকার পাঠক আমাদের কাক্সিক্ষত নয়। আমরা চাই সারাদেশে পাঠক তৈরি হোক।
কিন্ডারবুকস এক বছরের বেশি সময় পার করে ফেলল। দু-দুটো বইমেলায় অংশগ্রহণ করল। আপনার তৃপ্তির জায়গাটা সম্পর্কে জানতে চাই। অতৃপ্তির জায়গাটাও যদি বলতেন…
মাহমুদুল হাসান : কিন্ডারবুকস করা হয়েছে বাচ্চাদের সেবা দেওয়ার জন্য। মার্কেটে একটা শূন্যতা অনুভব করছি। বাচ্চারা যে ধরনের বই পছন্দ করে, অনেক সময় বই নষ্ট করে, ছুড়ে মারে, সেসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আমরা কোয়ালিটির ওপরে জোর দিয়েছি। উৎকৃষ্ট বাঁধাই, ভালো প্রিন্ট করার চেষ্টা করছি। ব্যবসার চেয়ে আমরা মনে করি এটা একটা সামাজিক দায়িত্ব। কারণ বাচ্চারাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের জ্ঞান অর্জনে সেবা দেওয়াই আমাদের ইচ্ছা। আমরা তৃপ্তি পাই, যখন দেখি, স্টলে বাচ্চাদের আনাগোনা থাকে। দেখা যাচ্ছে,
ছয়-সাত-আট বছরের বাচ্চারা তাদের বাবা-মাকে আঙুল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বই কিনতে চাইছে। দীর্ঘদিন মার্কেটে এই শূন্যতা ছিল। বাচ্চাদের প্রকাশনার বই মোটামুটি গেটাপ-মেকাপ একইরকম হয়ে থাকে। সেসব বাচ্চাদের খুব বেশি আকর্ষণ করতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি, বাচ্চাদের যে হাসিমুখ, তাদের যে উচ্ছ¡াসÑসেটা তৈরি করতে। তাদের বইয়ের জগতে এনগেজ করতে। এটা হচ্ছে তৃপ্তির জায়গা যে, পাঠকরা আমাদের সাড়া দিচ্ছে। অতৃপ্তির জায়গা হচ্ছে, বাচ্চারা ডিভাইসমুখী হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের আরও বইমুখী করা দরকার। প্রকাশক, অভিভাবক সবাইকে এ ব্যাপারে ভাবা উচিত।
কাগজের দাম বৃদ্ধি ও অপ্রতুলতা এবং ভালো প্রোডাকশন ও কন্টেন্টের অভাবÑসব মিলিয়ে প্রকাশনাশিল্পে একধরনের সংকট চলছে। বিশেষ করে শিশুদের প্রকাশনায়। এসব বিষয়ে কী ভাবছেন?
মাহমুদুল হাসান : কাগজের দাম বৃদ্ধিÑএটা অবশ্যই একটা বড় সমস্যা। সাধারণ কাগজ দিয়ে বড়দের বই করা যায় কখনও কখনও কিন্তু ছোটদের বইয়ের কাগজ ভালো দিতে হয়। সবকিছুর কথা মাথায় রেখে আমরা ভালো সেবা দিতে চাই। ভালো কাগজ পেলে ভালো প্রোডাকশন করা যায়, কিন্তু ভালো কন্টেন্ট থাকতে হবে। এজন্য কন্টেন্টাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। প্রথমে আমরা যখন কন্টেন্ট নির্বাচন করি, ওই জায়গাতে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ থাকে। বিবেচনায় থাকে কন্টেন্টা বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত কি না? একটা কন্টেন্টেকে ভালোভাবে উপস্থাপনের জন্য যে ধরনের কাগজ লাগে সেটা ব্যয়বহুল। এটার জন্য সরকার আমাদের একটা সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। বাচ্চাদের বই যারা
করেন তাদের সবাইকে কাগজ কেনার ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেওয়া। এটা প্রকাশকদের ভালো কোয়ালিটিসম্পন্ন বই করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

গত বছর বইমেলায় একটা প্রসঙ্গ উঠেছিল, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি প্রকাশকরা রয়েছেন, তারা অংশগ্রহণ করলে বইমেলার ব্যাপ্তি বাড়বে। আপনি এ ব্যাপারে কী মনে করেন?
মাহমুদুল হাসান : আমি মনে করি, মার্কেট ওপেন করে দেওয়া উচিত। আমরা তো ওখানে যাচ্ছি। মার্কেট যত নিয়মকানুনের মধ্যে রাখবেন, তত তার পরিসর ছোট হবে। বাংলা ভাষাকে সামনে রেখে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এটা বাংলাভাষাকেন্দ্রিক বইমেলা। অতএব বাংলাভাষী সকলেই এতে অংশগ্রহণ করতে পারে। দুই বাংলা মিলে যদি কাজ করতে পারি, তাতে কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। এতে ওদের লাভ, আমাদের লাভ আরও বেশি। কারণ আমাদের প্রকাশক, পাঠক বেশি। তারা যখন আসবেন তখন আমাদের ইকোনমির জন্য এটা ভালো হবে। ওদের টাকাটা আমাদের ইকোনমিতে যুক্ত হবে। ওরা যেহেতু আমাদের জন্য দরজা খোলা রেখেছেন, আমাদেরও উচিত ওদের জন্য দরজা খোলা রাখা। এতে মার্কেট বাড়বে।
একটা বিষয় প্রায়ই আলোচনায় আসে, প্রকাশনাকে এখনও ‘শিল্প’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাপুসের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। প্রেস, প্রিন্টিং, বাইন্ডিং একসঙ্গে ইপিজেডের মতো করা যায় কি না? সেরকম পরিকল্পনা সরকারের আছে কি না?
মাহমুদুল হাসান : বাপুস অনেক আগে থেকেই এটা নিয়ে কাজ করছে। আমরা এখনও স্বীকৃতি পাইনি। প্রকাশনা ব্যবসায় লক্ষ লক্ষ লোক জড়িত। আমাদের পাঠক যারা রয়েছেন, তারা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন। হাজার হাজার
ইন্ডাস্ট্রির মানুষ বইমেলায় আসেন। বইয়ের মাধ্যমে সবাই কানেক্টেড। প্রকাশনা একটা বড় ইন্ডাস্ট্রি। আশা করি, সরকার সামনের দিনে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে সমিতিগতভাবে কাজ করার ইচ্ছে আছে। ইপিজেড আকারে করতে পারি কি না। যারা কোয়ালিটি পাবলিশিং করেন, তারা এই সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে পেলে আরও দ্রæতগতিতে প্রকাশনাশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাবেন।
আমরা বাইরের বইগুলো এখানে উৎপাদন করে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মতো বাজারজাতকরণ করতে পারি কি না? যেহেতু এখানে আমাদের খরচ কম। বাপুসের পক্ষ থেকে এরকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না?
মাহমুদুল হাসান : এটা আমরা করতে পারি। এখানে সরকারের সহায়তা লাগবে। কম খরচের কারণে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়েছে তা নয়, সরকার লিটেরারি তাদের নার্চার করছে। বিভিন্নভাবে তাদেরকে সুবিধা দিচ্ছে। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মতো বইকে একটা বড় মার্কেটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বইয়ের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া যেমন বড় মার্কেট, আফ্রিকাতেও তাই। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান কোয়ালিটির বই আমরা দিতে পারব। এখানে লেবার সস্তা। আমাদের যে সমস্ত কাঁচামাল বাইরে থেকে আনতে হয়, সেসব যদি ট্যাক্স ফ্রি করা যায়, গার্মেন্টস যে সুবিধাগুলো পেয়ে আসছে, সেই সুবিধাগুলো যদি পাওয়া যায়, তাহলে একটা বড় ইন্ডাস্ট্রিতে পৌঁছানো সম্ভব। আমরা এই শিল্পটাতে বড় একটা পরিবর্তন আনতে পারব। আমাদের সেই দক্ষ ম্যানপাওয়ার আছে।
কিন্ডারবুকস নিয়ে আপনার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন গত বছর এক সাক্ষাৎকারে। এই পর্যায়ে এসে কাজটি কতটা চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছে?
মাহমুদুল হাসান : চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছে না। এটা একটা প্রসেস। আমাদের লক্ষ্য এমন নয় যে দুই বা তিন বছরে আমাদের প্রফিট আনতে হবে। এটাকে কালচার হিসেবে দেখছি। আমাদের দেশের বিখ্যাত যে লেখকরা আছেন, তারা কিন্তু হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠিত হননি। কিন্ডারবুকসকে আমরা চাচ্ছি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই ব্র্যান্ডের কোনো কন্টেন্ট মানেই সুপার কন্টেন্ট। চ্যালেঞ্জিং আমি বলব না। এটা একটা দীর্ঘ যাত্রা। যে যাত্রায় আমরা স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাচ্ছি। হয়তো আরও কয়েক বছর পর ভালো বুঝতে পারব, আমরা কতটা এগিয়েছি। অবশ্যই কিন্ডারবুকস নিয়ে স্বপ্ন আমাদের সীমাহীন।