Homeফিকশনকরোনাকালের বসন্ত | তাপস রায়

করোনাকালের বসন্ত | তাপস রায়

শান্তিনিকেতনে দেহলীর বারান্দায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে আছেন। পরনে বাসন্তী রঙের সিল্কের জোব্বা। তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে রানী চন্দ এই অপরূপ সাজের কারণ জানতে চাইলেন।

গুরুদেব বললেন, আমি যদি বসন্তকে আহ্বান না করি তো কে করবে বল? বসে বসে বসন্তকে আহ্বান করছি।

এর বহু বছর পর আরেকজন কবি লিখলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’

এই পঙ্ক্তি লেখার আগে বসন্তের প্রতীক্ষায় কবিবরের কি ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল? আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে কল্পনায় দোষ কী? দিব্যি দেখতে পাচ্ছিÑ দেহলীর বারান্দায় কবি বসে আছেন। বসন্তকে ডাকছেন। পরনে রঙিন জোব্বা। মুখে মাস্ক!

রানী চন্দরা কবিকে এতটা অসতর্ক হতে দিতেন না নিশ্চয়ই। সতর্ক না হয়ে উপায়ও নেই। এ নিয়ে তর্ক চলে না।

মর্ত্যে আজ বসন্ত। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, অরণ্যের অগ্নিশিখারা দুলছে। কৃষ্ণচূড়া, কনকচাঁপাও আছে। দখিনা বাতাসের দস্যিপনাও চাপা থাকছে না। হঠাৎ এলোমেলো করে দিচ্ছে খোলা চুল, শাড়ির আঁচল। বনে বনে কোকিলের কুউউউ-ডাক শোনা যাচ্ছে। মন থেকেই শুধু ‘কু’ সরছে না।

বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধে এই বসন্তে বড় ভয়! অন্ধের মতো দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্তর্জাল খুলে বসে আছি। কিন্তু ভ্রমটাকে কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না। অথচ প্রাণ-ভোমরার সুরক্ষা বলে কথা!

টাইমলাইনে বিশেষদে ছড়াছড়ি। কর্তার কড়াকড়িও কম নেই। ব্যস্ত ভঙ্গীতে তর্জনী নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে প্যাঁচ কষিয়ে কাজের লোকের হাত ধোয়ার হিসাব নিচ্ছেন। অথচ বেচারা প্রতিদিন হাত-পা ধোয়ার চেয়ে মাসে একবার বিছানার চাদর ধুতেই বেশি আগ্রহী।

এদিকে কর্তার হয়েছে জ্বালা। গিন্নিমার আদেশÑ ঘরেও মাস্ক পরে থাকতে হবে! তথাস্তু। কিন্তু পানের পিক ফেলতে গিয়ে জেরবার। হাত ধোয়ার বদলে মাস্ক বারবার ধুতে হচ্ছে। তারপরও মেনে নিয়েছেন। এতো দিন নাকে-মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সংসার সামলেছেন, এখন মাস্ক পরে করোনা সামলাচ্ছেন। তবুও তিষ্ঠোতে পারছেন না।  ধৈর্যের বাধ ভাঙলেই ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে মাস্ক ছুড়ে ফেলছেন ঘরের কোণায়। 

ছোট মেয়েটা ঘরকুনো নয়। ফড়িং স্বভাব। ধার ধারে না। মনে অচলায়তন ভাঙার স্বপ্ন। মুখ সবসময় আয়নায়।  বিদ্রোহী কবির ‘চল্্ চল্্ চল্্’ তার প্রিয়। যদিও এর পরের পঙ্ক্তি কিছুতেই মনে থাকে না। সে চেষ্টাও নাই। মাস্ক পরা মুখগুলো তার মুখপোড়া হনুমানের মতো লাগে! সেদিন ক্যাম্পাসে বয়ফ্রেন্ডকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেÑ মাস্ক পরে তার সামনে না আসতে।

ছেলেটি রা করেনি। সাচ্চা প্রেমিক। সে জানে, প্রেমের কাছে জীবনের মূল্য নস্যি। সো নো টেনশন, নো টেনশন, অনলি অ্যাটেনশন। এমনও বসন্ত দিনে বেচারা সেদিন ঘরে ফিরেছিল স্যানিটাইজার কিনে। ওই স্যানিটাইজারই পরদিন কাল হলো। নিভৃতে করতলে প্রেয়সীর মুখ তুলে ধরতেই প্রেমাবেগ প্রপাতধরণীতল!

তোমার হাতে এমন গন্ধ ক্যান?

কেমন গন্ধ!

এই যে! মেয়েটি তালুতে নাক ঘষে। পরক্ষণইে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে।

ধুর! ছেলেটি পাত্তা দেয় না।

বললেই হলো। কেমন বোটকা গন্ধ!

ও, স্যানিটাইজার। ছেলেটি হো হো করে হাসে।  

মেয়ের মেজাজ ততক্ষণে তুঙ্গে। তুমি জানো নাÑ ডেটলের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। গা গোলায়।

ডেটল, স্যানিটাইজার পিসতুতো ভাই হলেও এক নয়Ñ কে বোঝাবে তাকে! দুই মেরুতে জমে থাকা হাজার বছরের বরফ গলতে শুরু করে। তবুও মেয়ের মন গলে না। রাতে শুয়ে শুয়ে ছেলেটি ভাবেÑ ভুলটা কার?

প্রকৃতির কাছে মানুষের পাপ কম নয়! কৃষক গরুর মুখে ঠুলি পরিয়ে রাখে, যাতে অন্যের খেতে মুখ না দেয়। মানুষের দে দে খাই খাই স্বভাব যায় না। বগুড়ার দই থেকে বিসমিল্লাহ্র সানাই হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খায়। মাগনা আলকাতরা উহ্য রইল। এক্ষণে গরু যদি সৃষ্টিকর্তার পায়ে মাথা কুটে বলে, প্রভু, এ অবিচার। এ অসহ্য। সৃষ্টিকর্তাই বা কেন এত সহ্য করবেন? তিনি কি আর জানেন না, তারই সৃষ্টি ‘সেরা জীব’ কতটা ধূর্ত, কত বাটপার, কত ছল ওদের, কত মুখোশ!

সুতরাং তারই নির্দেশÑ নে এবার মাস্ক পরে থাক।

স্বজাতিকে দূর থেকে সালাম দিতেও মানুষের কত অনীহা। এখন এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করতেও ভয়! এর বদলে এলবো শেক, ফুটশেকÑ কত পাঁয়তারা! ভাগ্যিস বাঙালির হাঁটু ভাঁজ করে মোরগ লড়াইয়ের কথা ডব্লুএইচও জানে না। জানলে হ্যান্ডশেকের বদলে ককশেকের পরামর্শ দিত।

হ্যাঁ, এই বসন্তে একমাত্র পরামর্শই মুফতে মিলছে। সরকার দিচ্ছে, সমাজ দিচ্ছে, সংগঠন দিচ্ছে, অফিস দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও সোচ্চার। গুজব দ্রুত ডালপালা ছড়াচ্ছে। কর্তার মাথায় চেপে বসছে দুশ্চিন্তা। বিপি বাড়ছে, সুগারও হাই। ওই নিয়ে ছুটছেন সুপার শপে। গিয়েই খাচ্ছেন শক্! পঞ্চাশ টাকার মাস্ক দেড়শ টাকা। দেড় কদম সরলেই সর্বনাশ! অন্যজন ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে।  

চাকরিপ্রার্থীর লাইনকেও হার মানিয়েছে স্যানিটাইজার কেনার লাইন। অনলাইনেও মিলছে না হ্যান্ডওয়াশ। বিষ খাওয়ার পর স্টমাক ওয়াশের মতো গোডাউন ধুয়েমুছে পরিষ্কার।  

সেদিন পরিচিত একজনের বাসায় গিয়েছি। ড্রইংরুমে বসতেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার এনে সামনে রাখলেন। হাঁচি-কাশির স্বাধীনতা আমরা হারিয়েছি। এবার বুঝি চা-নাস্তার রেওয়াজও হারালাম। ভেতরটা ফুঁসে উঠল। অচেতনে হাত ঢুকে গেল পকেটে। সার্জিক্যাল মাস্ক বের করে নাকে চাপালাম; ঘরের মধ্যেই।

ভদ্রলোক মাস্ক দেখেই স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলেন। ভাবটা এমন উহান থেকে পোর্ট গলিয়ে থার্মাল স্ক্যানার ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছি তার ড্রইংরুমে। মানে লাগলেও, মনে মনে ভাবলাম, যাক্ একটু হলেও ভড়কে দিতে পেরেছি। প্রতিশোধ নেওয়ার এও এক তরিকা বটে!

এবার তার আতঙ্কিত প্রশ্নÑ ভাই, আপনার কি ঠান্ডা, কাশির সমস্যা আছে?

কঁই, নাঁ তোঁ! মাস্কের কারণে কথাটা নিজের কাছেই ভুতুড়ে মনে হলো। হেসে পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে চাইলাম।

ভদ্রলোক কূলে ভিড়তেই রাজি নন! দূর থেকেই বললেন, তাহলে মাস্কের নীল অংশ বাইরে রেখেছেন কেন?

তাই তো! মাস্কের সাদা-নীলের গোল এখন টক অব দি ওয়ার্ল্ড। কে বেলেছে? ‘হু’ বলেছে। সাদা মানে আপনি আক্রান্ত নন। নীল মানেই করোনাক্রান্ত। উফ্ এই কথাটা মনে ছিল না। সামান্য ভুলে ধরা খেয়ে গেলাম!

এরপর আর কথা জমল না। দ্রুত কাজ শেষে বেরিয়ে আসার সময় ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন; ভদ্রতার খাতিরেই। আমি ধার দিয়েও গেলাম না। মুখে ‘চলি তাহলে’ বলেই হাঁটু ভাঁজ করে সামনে চালিয়ে দিলাম।

করোনা ঠেকাতে করণীয় যার জানা সেই করিৎকর্মার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেহারা লিফটের দরজা আটকে যেতে যেতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ককশেকের কথাটা আর বলা হলো না।

মনটা ফুরফুরেই ছিল। আনন্দ ফুৎকারে মিলিয়ে যেতে সময় লাগল না। একেই বলে হরিষে বিষাদ। এখন হরিই ভরসা। দরজা খুলেই অর্ধাঙ্গিনী পথ আগলে দাঁড়ালেন। সর্বাঙ্গ থরথর। ভয়ে নয় রাগেÑ বোঝা গেল একটু পরেই। দোষ আমারই। ক’দিন থেকেই তিনি মাস্কের কথা বলছিলেন। বলাটা এখন দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিছুতেই দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

বাসন্তী রঙের তার সব আছেÑ চুড়ি, কানের দুল, টিপ; শুধু নেই মাস্ক। যে কারণে তিনি কোথাও বেরুতে পারছেন না। অথচ আমার দম বেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা। বিশ্ব সংসার যেখানে মাস্কশূন্য সেখানে আবার বাসন্তী কালারের মাস্কÑ বলিহারি বায়না!

আমি করোনার কথা বলে করুণা চাইÑ তোমার দাবি পূরণ অসম্ভব প্রিয়ে। তুমি অন্য বর চাও।

গিন্নি তেতে ওঠেন, হ্যাঁ তাই চাইব। সামান্য একটা মাস্ক…

সামান্য নয়। বলতে গিয়েই চোখ আটকে গেল বেলকনিতে। কাপড়ের আড়ালে শুকোতে দেওয়া হলুদ বক্ষবন্ধনী ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঝুলে পড়লাম গিন্নির গলায়। রসে একপাক গড়িয়ে গরগর করে বললাম, ছাদনাতলাতেই কথা দিয়েছিলামÑ বাঁচব একসঙ্গে, মরব একসঙ্গে। আজ কথা দিচ্ছিÑ মারবও একসঙ্গে।

অ্যাঁ! কাকে? গিন্নি প্রায় ছিটকে ওঠেন।

আমি বলি, কেন, করোনাভাইরাস। শুধু তাই নয়, আজ রাতেই আমি তোমাকে একটা নয়, দু’ দুটো হলুদ মাস্ক বানিয়ে দেব। এবার খুশি?

গিন্নির চেহারায় খুশির ছিটেফোঁটাও মিলল না। হ্যাঁচকা টানে হাত দুটো সরিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে বিড়বিড় করে কী বললেন বোঝা গেল না। বোঝার চেষ্টাও বৃথা। অর্ধাঙ্গিনীর

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular