Homeফিকশনপাতা | মুম রহমান

পাতা | মুম রহমান

১.

পাতা একটা স্কুলে পড়াত। কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমাদের মহল্লাতেই। আরও সোজা করে বললে আমাদের বাড়িতেই। মানে আমাদের বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে স্কুলটা করা হয়েছিল। সাকুল্যে স্কুলটায় শ’খানেক ছেলেমেয়ে পড়ত। পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাগুলো হাঁস-মুরগির মতো কিচিরমিচির করে আসত। সকালে। সাতটায়। আমি তখন বারান্দায় বসে কফি খেতাম আর পাতাকে দেখতাম। পায়ে হেঁটে আসত সে। তার মানে আশেপাশেই বাড়ি। কপালে একটা বড় টিপ। সবসময় শাড়ি পরত। মুখটা একটু লম্বাটে, চোখটা মুখের তুলনায় বড়। ঘাড়টা সুন্দর। আমার তিনতলার বারান্দা থেকে ওর লম্বাটে ঘাড়টা দেখে মদিগ্লিয়ানির আঁকা নারীগুলোর কথা মনে পড়ত।

পাতা কেমন নাম? কেন ওর নাম পাতা? আমি ভাবতাম, ওর বাবা বা মা বা কোনো আত্মীয়স¦জন কী ভেবে ওর নাম পাতা রেখেছিল? ভেবে কোনো কিছু বের করতে পারিনি। কারণ ওর মুখটা তো পাতার মতো নয়। পান পাতা, বরই পাতা, আম পাতা, তেঁতুল পাতা, নারকেল পাতা, আঙুর পাতা, গাঁজা পাতাÑজগতে কতরকমের পাতাই তো আছে। কী মনে করে মানুষের নাম পাতা রাখা হলো!

আমাদের নিচতলার কিন্ডারগার্টেনটা যে চালাত, সে আমাদেরই মহল্লার এক ছোটভাই। নয়ন তার নাম। ছোটবেলা থেকেই চিনি। নয়নকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, কীরে তোদের ওই মাস্টারনির নাম কী? ওই যে সব সময় শাড়ি পরে, নানারকমের আজব আজব ব্লাউজ পরে?

—হোয়াট ইজ দ্য ঘটনা বড় ভাই, মনে ধরছে? নাকি চোখে পড়ছে?

—ফাইজলামি রাখ। ধরেও নাই কোথাও, পড়েও নাই। এমনেই। কৌতূহল।

—উনার নাম পাতা।

—পাতা?

—হ।

—এ কেমন কথা।

—পুরা নাম কিন্তু এক্কেবারে ঐসলামিক।

—সেইটা কীরকম?

—মোসাম্মত আলিফা।

আমার পরে একটু অনুশোচনাই হয়েছিল। কথা নাই, বার্তা নাই, হুট করে একজনরে নাম জানতে চাইলাম নয়নের কাছে। ও কী ভাববে?

কে কী ভাবল তা নিয়ে অবশ্য আমি কোনোকালেই পাত্তা দেই না।

কিন্তু পাতাকে নিয়ে আমি ভাবতে থাকলাম।

বারান্দায় বসে চা-কফি খাই। পাতাকে আসতে দেখি। আর ভাবি, কোন বাড়ির মেয়ে?

একদিন গেটে তালা দিচ্ছি, হাত থেকে তালাটা পড়ে গেল। পড়বি তো পড় আমার পায়েই। তালাটার ওজন আধা কেজি না হলেও দু-আড়াইশ গ্রাম তো হবেই। ব্যথা পেলাম। পাতা বেরিয়ে এল স্কুলের দরজা দিয়ে।

—বরফ দিন। লেগেছে?

আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিনেমার দৃশ্যে এমন করে দেখা হতো নায়ক-নায়িকাদের। আমি কিছু বলার আগেই পাতা একটা বাটিতে করে কয়েক টুকরা বরফ নিয়ে এল। আমি পায়ে ঘষলাম। পাতাকে রীতিমাফিক ধন্যবাদ দিলাম। বললাম, আমি উপরতলায় থাকি।

      —জানি, আপনাদের বাড়ি।

—আমি একটা অ্যাড ফার্মে কাজ করি।

           —ও।

—আসবেন একদিন। চা-কফি খাব। আপনার নাম তো পাতা।

পাতা চমকে উঠল। কেঁপে উঠল।

—আপনি কী করে জানলেন?

—নয়নকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমি কিন্তু প্রতিদিন আপনাকে দেখি। উপর থেকে। আপনার যখন স্কুল টাইম শুরু হয় আমি তখন ব্যালকনিতে বসে চা খাই। সারাদিনে ওইটুকুই আমার আয়েশের সময়।

—ও।

      —আপনি খুব সুন্দর সেজেগুঁজে আসেন। দেখতে ভালো লাগে।

       —ও।

       —আপনার নাম পাতা কেন?

       —জানি না তো।

আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে পাতা চলে গেল। আমি বোকার মতো খানিক তাকিয়ে থাকলাম। ছ্যাবলামি করে ফেললাম কি না কে জানে! এভাবে যেচে এত কথা বলা ঠিক হয়নি। মেয়েটা কী ভাবল?

যা খুশি ভাবুক, মানুষের ভাবনাকে আমি পাত্তা দেই না।

২.

দিন দশেক পরের কথা। আমার অফিস যাওয়া হয়নি। জ্বর। আম্মারা গেছে মামাদের বাড়িতে। নানার কুলখানি নিয়ে কথা বলতে। আমি একা বাসায়। দরজায় কলিংবেল বাজল।

খুলতেই দেখি পাতা দাঁড়ানো।

ইতস্তত।

—স্যরি, বিরক্ত করলাম।

—মোটেও না। আসুন।

—আমি কিন্তু বাসায় একা।

—জ্বি!

পাতা এবারও কেঁপে উঠল। এই মেয়েটার বোধ হয় কাঁপুনি রোগ আছে।

—ভয় নেই, আমি কামড়াই না।

—ইয়ে আমি এমনিতেই এসেছি।

—চা খাবেন? নাকি কফি?

—না কিছু খাব না।

—বসুন দু’মিনিট।

পাতাকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে আমি ওভেনে কেটলি ঢুকিয়ে দেই। তিন মিনিটে গরম জল। আর্লগ্রে টি ঢেলে কেটলিটা ঢেকে দেই। কাঁচের কেটলি আর দুটো পেয়ালা নিয়ে পাতার সামনে হাজির। সঙ্গে প্লেটে দুটো বাকরখানি।

—আর্লগ্রে টি। ঘ্রাণটা সুন্দর। কিছুদিন আগে আনিয়েছি। খেয়ে দেখুন।

—আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি।

—বলুন।

—আমরা তো সবাই ঝরে যাব। আমরা সবাই পাতা।

—জ্বি!

—আপনি একদিন জানতে চেয়েছিলেন, আমার নাম পাতা কেন?

—কে দিলো এই উত্তর?

—কেউ না। উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। বড় ভাইবোনও নেই। আমি নিজেই উত্তরটা খুঁজে বের করেছি।

আমি কোনো কথা খুঁজে পাই না। পাতাকে পেয়ালায় চা ঢেলে দেই। বাকরখানি এগিয়ে দেই। কেন জানি আমার হাত কাঁপে, চোখ ভিজে আসে। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে গিয়ে পাতার হাতে হাত লাগে। ও বলে, আপনার জ্বর!

—হুম।

—কী কাণ্ড! আপনি জ্বর নিয়ে এসব করতে গেছেন!

—বললাম যে বাড়িতে কেউ নেই। আমি একা।

—আহা!

পাতা এমন করে আহা বলল যে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ইচ্ছা করল তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। তা কি আর সম্ভব?

আমি বলি, ঠিকই বলেছেন, আমরা সবাই পাতা, একদিন ঝরে যাব। আমরা সবাই ঝরাপাতা।

—আপনার মন খারাপ করে দিলাম।

—হুম।

—আপনি কেন প্রতিদিন আমাকে দেখেন?

—ভালো লাগে।

—আপনি এমনভাবে বসে থাকেন, মনে হয় যেন আমাকে দেখতেই…

—কথা ঠিক।

—ও। আচ্ছা, আজ যাই।

—কেন এলেন, কেন চলে যাবেন, কিছুই বুঝিনি।

—সব কি আর এক মুহূর্তে বোঝা যায়?

—আরও মুহূর্ত কি পাব?

—ঝরে পড়ার আগে হয়তো আরও দুয়েকটা মুহূর্ত পাওয়া যাবে। আসি।

যাবেন না পাতা, যেও না পাতা—আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে। আমি বলতে পারি না। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে ওকে বলি, আবার আসবেন কিন্তু।

—আসব।

পাতা আর আসেনি। সে গল্পটা এখন আর করতে ইচ্ছা করছে না। এখন আবার আমার মাথার ভেতরে ব্যথার করাত চলছে।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular