–সেলিনা হোসেন
‘উৎস থেকে নিরত্মর’ আমার প্রথম গল্পের বই। ১৯৬৯ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে আমি তখন রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়াশোনা করি। প্রথম জীবনে কবিতা দিয়েই সাহিত্যচর্চা শুরম্ন করেছিলাম। ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে গল্প লেখা শুরম্ন করি। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে একটি গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম গল্প পাঠাই। সেই গল্পটিই প্রথম স্থান অধিকার করে। স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম ওই গল্পের জন্য। ঘটনাটি আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। এরপর একের পর এক গল্প লিখতে থাকি।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর আমার শিড়্গক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ বললেন বই প্রকাশ করতে। একটা বই থাকলে চাকরি পেতে অনেক সুবিধা হবে। আমি তখন বললাম, কে আমার বই প্রকাশ করবে?
হাফিজ স্যার বললেন, কেউ করবে না। বাবা-মায়ের কাছে যাও, টাকা নিয়ে আসো। আমি একটা প্রেসের ব্যবস্থা করে দেব।
শুরম্ন হলো বই ছাপানোর চেষ্টা। টাকা যোগাড় হলো। ছাপার কাজও শুরম্ন হলো। মো. আবদুর রশিদ খানের আইডিয়াল প্রিন্টিং ওয়ার্কস ছিল তখনকার রাজশাহী শহরের আধুনিক প্রেস। সেটি গ্রেটার রোডের ওপরে কাদিরগঞ্জে অবস্থিত ছিল। এখনও আছে কি না জানি না; একদিন প্রম্নফ দেখার সময় এলো। প্রম্নফ তো দেখতে জানি না, তখন রশিদ সাহেবই সাহায্য করেছিলেন। দারম্নণ উত্তেজনা! তখন চাকরির কথা ভুলতে বসেছি। বই হচ্ছে এটাই বড় কথা। হাফিজ স্যার ঢাকায় এসে আমার বইয়ের প্রচ্ছদ ও বস্নক করিয়ে আনলেন। প্রচ্ছদশিল্পী এম. মনসুর আহমদ। প্রকাশক হিসেবে নাম ছাপা হলো মো. আবদুর রশিদ খানের আর পরিবেশক করা হলো নওরোজ কিতাবি¯ত্মানকে। বইয়ের মূল্য চার টাকা। বই প্রকাশের ধকল আমাকে কিছুই সইতে হয়নি। শুধু প্রকাশের আনন্দটুকু ছিল আমার। আমি কৃতজ্ঞ আমার শিড়্গক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছে।
এই বইয়ের সূত্রে আমি দুটি চাকরি পাই। একটি ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশনে, যেখানে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন মুনীর চৌধুরী। আরেকটি ছিল বাংলা একাডেমিতে। সেখানে ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন কবীর চৌধুরী, ড. এনামুল হক, আব্দুলস্নাহ আল-মুতী এবং ড. নীলিমা ইব্রাহিম।
‘উৎস থেকে নিরšত্মর’ বইয়ের গল্পগুলো ছিল মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্তের সামাজিক বা¯ত্মবতা প্রাধান্য পেয়েছিল। গল্পগুলো যখন লিখেছিলাম, জীবনকে জানার অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছিলাম। বই করার সময় তার উদ্দেশ্য একদম ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদটা প্রধান হয়ে উঠেছিল। জানি বেশিরভাগ ড়্গেেত্র প্রথম বইয়ের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি থাকে। এও জানি শিল্পের সিঁড়ি ভাঙা প্রচ- কষ্টের। এই ব্যর্থতা এবং কষ্টের বোধগুলো অতিক্রম করার জন্য দিনরাত আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমার প্রথম বই প্রকাশের সময়ে শিল্পের বোধ আমার মধ্যে কাজ করেনি। কাজ করেছিল প্রয়োজন, লড়াইয়ের তাগাদা। চাকরি আমাকে গৃহবন্দি থাকার অর্থনৈতিক গস্নানি থেকে বাঁচিয়েছিল।
‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় হুমায়ুন আজাদ আমার প্রথম বইয়ের সমালোচনা প্রসঙ্গে ভালোমন্দ অনেক কথা লেখার শেষে লিখেছিলেন, সেলিনা হোসেনের দুঃসাহসই আমার চোখে অধিক পড়েছে। আমরা দুঃসাহসীদেরই চাই, তাই তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
হুমায়ুনের এই লাইন দুটো আমার সবসময় মনে পড়ে। কারণ আমি দুঃসাহসটুকুকেই সম্বল করতে চাই। দুঃসাহস না থাকলে যে এগোনো যায় না।