Homeফিকশনমেলার মাঠের প্রেম | অরুণ কুমার বিশ্বাস

মেলার মাঠের প্রেম | অরুণ কুমার বিশ্বাস

মেয়েটার সবই ঠিক আছে, শুধু নামটাই যা একটু সেকেলে। নাম তার জবা, বন্ধুরা মজা করে ডাকে জবাকুসুম। কুসুম মানে ফুল বা পুষ্প, আপনারাও জানেন। জবা একরকম ফুল, বন্ধুরা তাই ভুল কিছু বলেনি, বরং জবাফুলকে রসিয়ে কষিয়ে ‘জবাকুসুম’ বলাই যায়।

   কিন্তু অন্যরা আপত্তি না করলেও বিপত্তি ঘটিয়েছে একজন—সে ফয়সল। জবাকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা-মশকরা করলে তার বড্ড বুকে বাজে, সাথে সাথে আপত্তি জানায়, উহুঁ! জবার নাম নিয়ে কেউ ক্যারিকেচার করবে না। আমি কিন্তু মোটেও তা সহ্য করব না। জবা একটা ভালো মেয়ে, তাকে নিয়ে যা নয় তাই রটনা! এসব চলবে না, চলতে দেওয়া হবে না।   

    ফয়সলের এই প্রতিবাদী রূপ দেখে মুচকি হাসে জবা। মনে মনে একটু খুশিও হয় বোধ করি। কারণটা কী অনুধাবন করতে পারেন! বোধ করি পারেন, কারণ তাদের বয়সটা একটু এলোমেলো, সময়টাও ভালো নয়। সামনে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ‘লাইন ধরে জোরজবরদস্তি’ প্রেমের মৌসুম আসছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে বলে একটা কথা চালু আছে। আপনি যতই ভিনদেশি কালচার মানবেন না বলে গলা ফাটান, প্রজন্ম কিন্তু তা শুনছে না। প্রেম দিবসে ওরা ভরপুর প্রেম করবেই। করতেই হবে।    

     তো কী বোঝা গেল—জবা আর ফয়সলের মধ্যে কিছু একটা আছে। চলছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, ওদের দুজনের কেউই কিন্তু মুখ ফুটে তা স্বীকার করছে না। তারা ডুবে ডুবে বেশ পানি পান করছে, আর ভাবছে কেউ তা টের পাবে না। কিন্তু পাবলিক তো অমন বোকা নয়, বরং তারা সবসময় একলাইন বেশি বোঝে। এইজন্যই আজ আমাদের জাতির এই অবস্থা। জাতীয় পতাকার দেখবেন রঙ ঠিক নেই, সবাই খালি ঝুঁড়ি ঝুঁড়ি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়, কথা আর কাজের প্রায়শ কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।   

    মিল না-থাক, জবার সঙ্গে ফয়সলের ফুটিফুটি প্রেম, এটাই হল গিয়ে মোদ্দা কথা। মেলা চলছে, বইমেলা। কাব্যি করে কেউ কেউ বলে, একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। অথচ শুদ্ধ করে দুলাইন বাংলা বলা বা লেখায় আমাদের অনেকেরই কোনো পারঙ্গমতা নেই। আমরা যা মনে আসে তাই বলি, তাই লেখি, আর আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এমন সব জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলি, যা কিনা বাঙালি হয়েও আমরা অনেকেই তার মর্মবাণী উদ্ধার করতে পারি না।

   বইমেলা চলমান। শত শত স্টল, হাজারে হাজারে মানুষ কাতারে কাতারে দাগিয়ে মেলার মাঠে গুঁতোগুঁতি করছে। কেউ চা-সিঙারা, আইসক্রিম সাঁটাচ্ছে। কেউ বা তুমুল আড্ডা দিচ্ছে, আবার কেউ বইমেলার অছিলায় অল্পপরিচিত ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে প্রেমের পাঁয়তারা করছে।

    তক্কাতক্কিও বড় কম হয় না মেলার মাঠে। প্রতিবছরই সদ্য ঘোষিত পুরস্কার নিয়ে বেশুমার তর্কবিতর্ক হয়। কেউ বলে ওই বেটা লেখে কী! কী এমন অবদান রয়েছে তার! স্রেফ স্বজনপ্রীতি আর তোষামোদির জোরে পদক বাগিয়েছে। বলাবাহুল্য, পদকপ্রাপ্তির পরেই কেবল আমরা কয়েকজনকে চিনতে পারি, আমজনতা আগে যাদের নাম অব্দি শোনেনি!

   জবাকে বগলদাবা করে মেলায় ঢোকে ফয়সল। বলতে নেই, ওদের প্রেমে ইদানিং বেশ জোশের সঞ্চার হয়েছে। জবার বেশ কিছু পছন্দের লেখক আছেন। তারা সব ‘সেলিব্রেটি’ লেখক। এরা আসলে লেখার চেয়ে বকে বেশি, পর্দায় চেহারা দেখাতেই বেশি ব্যস্ত এরা। ‘মোটিভাষণ’ লেখক আছে একদল—এরা যে কী বলে আর কী লেখে, বোঝে সাধ্যি কার!

    জবা প্রগাঢ় স্বরে বলল, ফসু, চলো ওইদিকে যাই। বস্তুত, ফয়সলের প্রেম-চুপচুপে নাম ফসু।    

 কেন কেন, ওইদিকে কেন? আইসক্রিম খাবে, জবা?  

   না না, ভীষণ ঠান্ডার ধাত আমার। আইসফাইস চলবে না। অন্য কিছু খাই চলো। জবা মুখ মুচড়ে বলল। কিন্তু ফসু তা শুনতে নারাজ। তার এক বন্ধুর বই বেরিয়েছে এবার। প্রথম বইÑপ্রথম সন্তানের মতোই কাম্য এবং প্রার্থিত। বলল, চলো জবা, আগে মগার বইটা কিনে আনি। পরে খাদ্যখানা হবে।

    মগা! কে মগা! এমন কারও নাম হয়! 

  হয় তো। তুমিও তাকে চেনো জবা। সে নাকি তোমার! কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় ফসু ওরফে ফয়সল।

   চিনি না তো। মগা নামে আমার কোনো বন্ধু ছিল না। নেইও।

   আরে, ওটা তো তার নিকনেম। পুরো নাম মইনুল গাজী। সংক্ষেপে মগা। হা হা হা! একচোট হেসে নেয় ফসু। কারণ প্রেমোচিত ভাষায় জবা তাকে ফসু ডাকলেও নামটা ওর পছন্দ হয়নি। কেমন যেন লুচু লুচু লাগে। মানে হয়!

   মইনুলের কথা উঠতেই জবার মুখের রঙবদল হয়। সে যেন একটু ঘাবড়ে যায়, হলুদ জবার রঙ সহসাই লালাভ হয়। কেসটা কী! ফয়সল ওর প্রতিক্রিয়া দেখে, আর ভাবে জবার সঙ্গে মগার সম্পর্কটা আসলে কত দিনের আর কত গভীর! লিটনের ফ্ল্যাট পর্যন্ত এগিয়েছিল কি! তাহলে তো সাড়ে সব্বোনাশ। পুরো দাম দিয়ে কেউ সেকেন্ড হ্যান্ড কেনে! আনকোরা চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। 

     ফসু আবারও তাড়া দেয়। চলো, মেলার ভিড় বাড়ার আগেই মগার বইটা কিনি। নইলে ও বেটা মাইন্ড করবে। মুরগি-ধরা প্রকাশকের থেকে বই প্রকাশ করেছে। পুরো মাসে অন্তত দু-তিনশ বই বেচতে না পারলে তো তার জামানত মারা পড়বে। আর কেউ তার বই ছাপবে! বন্ধু হিসেবে এটুকু দায়িত্ব তোÑ! আবারও কথা অসম্পূর্ণ রাখে ফয়সল। সে জবাকে দেখে আবার বোঝার চেষ্টা করে, মগার সঙ্গে সম্পর্কটা লিটন অব্দিÑ। আর এগোয় না ফসু। সে ভাবতেও ভয় পায়। সবে জবার সঙ্গে তার কুসুমগরম সম্পর্কটা হচ্ছিল আর কি! এর মধ্যেই হুড়কো! 

     তারপর সে এক মজার দৃশ্য পরিদৃশ্যমান হতে থাকে। ফসু তার আনকোরা প্রেয়সী জবার বগল ধরে টানে মগার বই কিনবে বলে, আর জবা উল্টো দিকে টোল খায়, মগাকে মিট করবে না বলে। কারণ তার ভয়, পাছে মইনুল ওরফে মগা তার বইয়ে জবার সাঙ্গে তার লটঘট নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখে বসে আছে!  

       যারা বই কেনে না, পড়ে না বা প্রকাশকও নয়, এমন আড্ডাবাজ আগন্তুকগণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জবা আর ফসুর এই ‘টাগ অব ওয়ার’ দেখো। দেখে আর হাসে আরও একজনÑসে হল জবার প্রাক্তন পুরুষ মইনুল গাজী ওরফে মগা। ওদের এই টানাটানি চলতেই থাকে, যতক্ষণ না বেরসিক পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে।   

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular