Homeকলামশঙ্কা ছিল ‘জলপুত্র’র ভাষা পাঠক বুঝবে না

শঙ্কা ছিল ‘জলপুত্র’র ভাষা পাঠক বুঝবে না

-হরিশংকর জলদাস

আমার প্রথম প্রকাশিত বই একটি উপন্যাস, নাম ‘জলপুত্র’। উপন্যাসটি যখন বেরোয়, তখন আমার বয়স পঞ্চান্ন বছর। প্রচলিত কথা অনুসারে, পঞ্চাশের ওপর যাদের বয়স তারা ধর্ম অনুরাগী হয়। হিন্দুরা গয়া-কাশিতে যায় পুণ্য সঞ্চয় করার জন্য, নানারকমের তীর্থভ্রমণ করে; আগের জীবনের পাপ স্খলিত করার চেষ্টা করে। আমি ঠিক সেই বয়সেই উপন্যাস লিখতে শুরম্ন করি। মজার ব্যাপার, এটাই আমার প্রথম বই। তার আগে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় দু’একটি প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুব বেশি কায়দা করতে পারিনি।
একদিন বইটি লেখা শুরম্ন করলাম, যখন আমি গবেষণা করছি নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস নিয়ে। তখন আমার এই উপন্যাস লেখার কথা মাথায় আসে। পা-ুলিপিটি প্রথমে ‘দৈনিক যুগাšত্মর’ এর ঈদসংখ্যায় একটা প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়েছিল। পত্রিকাটি তখন ঘোষণা দিয়েছিল, নবীন লেখকের পা-ুলিপি তারা আহ্বান করছে। যে পা-ুলিপি প্রথম বলে বিবেচিত হবে, সেটি ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হবে। আমার দুজন অধ্যাপক-ছাত্র জোর করেই পা-ুলিপিটি কম্পোজ করে সেই পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। তো আমার পা-ুলিপি প্রথম হয়।
সে ২০০৭ সালের কথা। পরের বছর মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘জলপুত্র’ উপন্যাস হয়ে বেরোয়।
‘জলপুত্র’ লেখা হয়েছে জেলেসমাজ নিয়ে। যে সমাজে আমি জন্মেছি। এই সমাজকে আমি ভালো করে চিনি। কিন্তু জেলেদের নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। উপন্যাসগুলোর সবই নদীভিত্তিক জেলেদের জীবন নিয়ে। আমি প্রথম সমুদ্রনির্ভর জেলেদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছি। খুব জেনেশুনে লিখেছি এমন নয়। পড়তাম প্রচুর। এখনও পড়ি। যখন পস্নট নির্মাণ করতে গেলাম আমি আমার সমাজকে বেছে নিলাম। যে সমাজের মানুষ বঙ্গোপসাগরের পাড়ে জীবনযাপন করে। জলশস্য আহরণ করে জীবন চালায়। উপন্যাসটি বেরনোর পরে পাঠক হয়তোবা নতুন একটা বিষয় খুঁজে পেলেন। ফলে পাঠক আমার প্রতি উৎসুক হয়েছে। আগ্রহ দেখিয়েছে।
‘জলপুত্র’ উপন্যাসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে কথোপকথনে ব্যবহার করেছি। এড়্গেেত্রও আমি একেবারে পুরোধা হিসেবে কাজ করেছি। এর আগে আহমদ ছফা তাঁর উপন্যাসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। সেই আঞ্চলিক ভাষা বোধগম্য করার জন্য তিনি প্রমিত বাংলায় লিখে দিয়েছেন। কিন্তু আমি সেটা করিনি। আমি একেবারে জেলেদের মুখের ভাষা ব্যবহার করেছি। আমি যে পাড়া থেকে উঠে এসেছি, কথা বলেছি, সেই ভাষাতেই আমার উপন্যাসে জেলেজীবনের চালচিত্র উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
প্রথমত, ‘জলপুত্র’ সমুদ্রপাড়ের জেলেদের নিয়ে লেখা। এ কারণে আমি খুব সন্দিগ্ধ ছিলাম, এই উপন্যাস পাঠক পড়বে না। দ্বিতীয়ত, দুঃসাহসের যে ব্যাপার, সেটা হলো আঞ্চলিক ভাষাকে প্রবলভাবে ব্যবহার করা। আমার আশঙ্কা ছিল, এই দুর্বোধ্য ভাষা পাঠক বুঝবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার, এই দুর্বোধ্য ভাষাকেই বাংলাদেশের নানা জেলার এমনকি পশ্চিম বাংলার অনেকগুলো অঞ্চলের পাঠক গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বহির্দেশীয় সাহিত্য হিসেবে এমএ-তে ‘জলপুত্র’ পাঠ্য হয়েছে। এ বিষয়গুলো আমাকে খুব উৎফুলস্ন করেছে। আমার ভয় কাটিয়ে দিয়েছে পাঠক। মাওলা ব্রাদার্স থেকে বইটি যখন বের হলো, মেলাতেই প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অথচ তখন আমাকে কেউ চিনত না। প্রথম উপন্যাসটা বেরনোর পরে আমার ভেতরে ভয়ঙ্কর রকমের আনন্দ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। যে আনন্দ আমাকে পরবর্তী উপন্যাস লেখার জন্য উৎসাহিত করেছে।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular