সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার জীবন কেটেছে একটা ঝড়ের মতো। সংগ্রাম, সংগ্রাম শুধু, এই ছিল জীবন। রোগ, শোক, অর্থাভাব, দেশ-বিদেশ, স্বপ্নের ঘোরে দিবারাত। জীবনে তাঁর সাথে পরিচয়ের শুরুতেই তিনি বিকট যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত। আমি তখন মেডিক্যালের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। তাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হওয়ার পর থেকেই দেখি, তিনি সবসময় কাশেন। সবসময় গরম জামা গায়ে পরে থাকেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ও কিছু না। বছরের এই সময়ে আমার একটু কাশি হয়।
যদি জিজ্ঞেস করি, ডাক্তার দেখাও না কেন? তিনি বলতেন, আমার ডাক্তার তো আছে। খুব ভালো ডাক্তার। জিন্না এভিন্যুতে প্র্যাকটিস করে। সেই আমাকে চিকিৎসা দেয়।
আমি যদি জিজ্ঞেস করতাম, কী চিকিৎসা দেন? তো তিনি আমাকে প্রেসক্রিপশন দেখাতেন। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল আর কাশির জন্য ম্যাড্রিবন ট্যাবলেট। পাকিস্তান আমলে এই ম্যাড্রিবন ট্যাবলেট খুব চলত। আমাকে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে তখন একদিন তাঁর ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে হলো। ডাক্তারের নাম খুব সম্ভব মাহবুব বা এই ধরনের কিছু। নিজেকে মেডিক্যাল স্টুডেন্ট বলে পরিচয় দিয়ে বললাম, এঁর জ্বর ভালো হয় না কেন? কাশি সর্বক্ষণ থাকে। আজ একবছর ধরে আমি এঁকে জানি, আমার সঙ্গে যতদিন ধরে পরিচয় ততদিন ধরে এই রকমের কাশি দেখছি।
অবশ্য কথাটা খুব ভয়ে ভয়ে বললাম। কারণ আমি তখনও স্টুডেন্ট। আর তিনি প্রতিষ্ঠিত একজন ডাক্তার। আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব বললেন, এটা হচ্ছে স্মোকার্স কফ। চিন্তা করার কিছু নেই। আমি ওঁকে অনেক দিন ধরেই চিনি।
আমি বললাম, শুনেছি ওঁর নাকি রোজ রাতে জ্বর আসে। আমার কথা শুনে সৈয়দ হক প্রতিবাদ করে বললেন, রোজ রাতে জ্বর আসে না, মাঝে মাঝে আসে। বছরের এই সময়টাতে আমার জ্বর আসে, আবার ভালো হয়ে যায়।
আমি তখন একটু সাহসী হয়ে বললাম, ডাক্তার সাহেব, ওঁর বুকের একটা এক্সরে করলে হয় না? আমার কথা শুনে বাতাসে হাতের একটা ভঙ্গি করে ডাক্তার সাহেব বললেন, না, এক্সরে করে কী হবে? এক্সরে লাগবে না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে আমার মনে শান্তি হলো না। তারপরও আমি কিছুদিন চুপ করে থাকলাম। কিন্তু তাঁর জ্বর বা কাশি কিছু ভালো হলো না।
আমি তখন আমার এক প্রিয় বান্ধবীর শরণাপন্ন হলাম। সে আমার ক্লাসমেট। সদ্য বিবাহিতা। স্বামী ডাক্তার। আমাদের মেডিকেল কলেজ থেকে কিছুদিন হলো পাশ করেছেন। আমার বান্ধবীর পছন্দের বিয়ে।
বান্ধবী বললেন, তুই ওই ডাক্তারের কথা শুনিসনে। আগে বুকের এক্সরেটা করে ফ্যাল, আমি মোয়াজ্জেমকে দিয়ে একটা ফরম লিখিয়ে নিচ্ছি। সোজা ভাইকে নিয়ে এক্সরে ডিপার্টমেন্টে চলে যা। ডাক্তার মোয়াজ্জেম আমার বান্ধবীর স্বামী। আমি বান্ধবীর পরামর্শ অনুযায়ী সেটাই করলাম। এক ঘণ্টার ভেতরেই রিপোর্ট হাতে চলে এল। সৈয়দ হক তার আগেই বুকের এক্সরে করে তাঁর বাড়িতে ফিরে গেছেন।
রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমি হতবাক! বাই ল্যাটারাল এক্সটেনসিভ পালমোনারি টিউবারকুলোসিস।
তাঁর দুটি লাংস ভর্তি যক্ষার জীবাণু দিয়ে। আমার মনে আছে রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমি ছুটলাম আমার বন্ধুর বাড়ির দিকে। হাসপাতালের পেছনেই রশিদ বিল্ডিয়ে। ওখানে ছিল ডাক্তারদের রেসিডেন্স।
তারপরের অবস্থা আরও করুণ। তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি; শিগগির ভর্তি হতে হবে, সময় নেই, এদিকে হাতে টাকা-পয়সা নেই, আমি মেডিকেলের একজন ছাত্রী, বাবার পাঠানো পয়সায় আমার চলে, আর সৈয়দ হক তখন কপদর্কহীন। কোনো চাকরি করেন না। শুধু লেখেন। এরপর তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে গেলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে। মুনির ভাই তখন দুপুরে খাবার খেতে বসবেন। আমরা গিয়ে তখন হাজির। সৈয়দ হক মুখে রুমাল রেখে সরাসরি বললেন, মুনির ভাই, আমার যক্ষ্মা হয়েছে। মহাখালি টিবি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
শুনে মুনির ভাই বললেন, তাই? তুমি মুখে রুমাল দিয়ে আছ কেন? রুমাল সরাও। চা খাও। ওরে, এখানে চা দে। ঘরের বাইরে হাঁক দিয়ে মুনির ভাই বললেন।
সৈয়দ হক ব্যস্ত হয়ে বললেন, আমি চা খাবো না। কাপ নষ্ট হয়ে যাবে! আমি এসেছি আপনার কাছে অর্থ সাহায্যের জন্য। শুনে মুনির ভাই বললেন, তুমি চা খাওয়ার পর কাপ আমি ভেঙে ফেলব, কিন্তু তুমি কাপে চা খাবে! আর টাকার জন্য ভেবো না, টাকা আমি তোমার বাড়িতে কাউকে দিয়ে পাঠাবো বিকালে।
জানিনে এ রকমের সুহৃদ আজকাল এই পৃথিবীতে পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু সেদিন মুনির চৌধুরী সৈয়দ হকের জীবনে যেন দেবদূতের ভূমিকা নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন বিকালেই অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী সাইকেলে করে তাঁর পিয়নকে টাকা হাতে লক্ষ্মীবাজারে পাঠিয়ে দেন। তিনি সে যাত্রা বেঁচে যান। মুনীর চৌধুরী তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন তাঁর ছাত্র।
তারপর বিয়ে হওয়ার বেশ কিছু বছর পর, বিদেশ ঘুরে আসার পর, ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটু থিতু হয়ে বসেছি, তখন একদিন তাঁর হার্ট অ্যাটাক হলো। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে তিনি সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিছু হিংসুক লোক লিখিতভাবে বললেন, এসব সৈয়দ হকের অ্যাটেনশন সিকিং ব্যবহার। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আমি তখন নিজে এক হাসপাতালের ডাক্তার। ছোট্ট দু’টি সন্তান নিয়ে জীবনের ক্যারিয়ার শুরু করেছি মাত্র। সেই মুহূর্তে তাঁকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। দেশ-বিদেশ। তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ছেলে-মেয়েদের ভাই-বোনদের জিম্মায় ফেলে রেখে তাঁকে নিয়ে দৌড়ালাম বিদেশে।
টাকা-পয়সা যেখানে যা ছিল, গয়নাগাটিসহ সব জোগাড় করে দৌড়ালাম। অপারেশন প্যাডে সিগনেচার দিলাম তাঁকে অজ্ঞান করে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে। একমাত্র আল্লার ভরসায়। সেখান থেকে ফিরলাম তিন মাস পরে। এদিকে আমার সংসার আর ছেলেমেয়ে লণ্ডভণ্ড। প্রাইভেট প্রাকটিস নিলাম। চাকরি একেবারে চলে যাওয়ার পথে। কোনোরকমে একে-তাকে ধরে চাকরি সামলালাম। তারপর সংসারের ঝামেলা যখন একটু কমল, ভাবলাম এবার দু’জনে দু’জনার, সমুখে নীল আকাশ আর সেই আকাশে আমাদের স্বপ্নের নীল ঘুড়ি, তখন দেখা দিলো তাঁর কাশি। তাঁর সারাজীবনভরই কাশি। তাই সে কাশিকে প্রথমে পাত্তা দিলাম না। যখন পাত্তা দিলাম তখন তিনি বেশ ভালোভাবেই ক্যানসারে আক্রান্ত।
আবার সব ফেলে ছুটলাম বিদেশ। এবারও অর্থের দিক দিয়ে নিঃস্ব। তবে এতদিনে নিজেদের সুন্দর একটি আবাস গড়ে নিতে পেরেছি। এবার বেশি কষ্ট হলো না। সরকার থেকে, বন্ধুবান্ধবেরাও যথেষ্ট সাহায্য করলেন। কিন্তু এবার আর তাঁকে ধরে রাখা গেল না। আইসিইউতে যাওয়ার শেষমুহূর্তে আমাকে বললেন, তুমি আমার হাত কিছুতেই ছাড়বে না!
আমি বললাম, না, কখনোই না! কিন্তু পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর। পৃথিবীর মানুষেরা বড় নিষ্ঠুর। তারা আমাদের দু’জনের হাত জোর করেই ছাড়িয়ে দিলো। তিনি এ পৃথিবীর মায়া দু’চোখে ভরে রেখেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। বিদায়ের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত রচনা করে গেলেন সাহিত্য। যা ছিল তাঁর জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য।
এই হলো আমাদের দু’জনের যুগল জীবন। এর ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, প্রণয়, মান, অভিমান, খুনশুটি। জীবনে সুখী হতে গেলে তো খুব বেশি কিছু লাগে না, ভাই। দু’জনে মিলে নান্দনিক জীবন ছিল আমাদের। কাব্য, সাহিত্য, ভ্রমণ, কথকতা, হাস্যরসিকতা দিয়ে ভরা ছিল আমাদের পৃথিবী। শতপ্রকারের জটিলতার ভেতরেও আমরা দু’জনে ছিলাম সুখী এক দম্পতি।
অনুলিখন : আরিফুল হক