আনোয়ারা সৈয়দ হক। জন্ম ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর, যশোর জেলায়। তিনি পেশায় চিকিৎসক হলেও কথাসাহিত্যে আপন দ্যুতিতে খ্যাতনামা। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও ছোটদের জন্য বিস্তর লিখেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পদক। একুশে পদকে ভূষিত এই কথাশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুল হাসান
- সাহিত্য কী? মানুষ কেন সাহিত্য পড়বে?
আনোয়ারা সৈয়দ হক : সাহিত্য মানুষের আবেগ প্রকাশের একটি সহজাত প্রক্রিয়া। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি এবং পরিবেশের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া। চিন্তা করো, যখন তথাকথিত ধ্রুপদী সাহিত্যের বিস্তার হয়নি, তখনও মানুষ তার গোষ্ঠীর ভেতরে গুনগুন করে পঙ্্ক্তি আওড়াত। পুঁথি-কথকতা-গ্রাম্য কিস্সা সব এর ভেতরে ছিল। আর নিরক্ষর মানুষ গোল হয়ে বসে তা মুগ্ধ হয়ে শুনত। আমার মনে হয়, এর মূলে হচ্ছে মানুষের অনুভূতির রোমান্টিকতা। মনে হয় প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব ভুবনে রোমান্টিক। মূর্খ মানুষকেও আমাদের প্রকৃতি রোমান্টিক করে গড়ে তুলতে পারে।
আমাদের জীবনে সাহিত্য অবশ্যই দরকার। নইলে এই মানবজনম ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষমাত্র, একবারই মাত্র, এই সুন্দর পৃথিবীতে আসে। তাই পারলে পৃথিবীর প্রতিটি কণা হাত দিয়ে ছুঁয়ে যেতে হবে। ঘরের কোণে বসে থাকলে চলবে না। জীবন উপভোগ করাও একরকমের সাহিত্যই বটে!
- কল্পনা ও সত্য কীভাবে সাহিত্যে সমন্বিত হয়ে ওঠে?
আনোয়ারা সৈয়দ হক : এটা নির্ভর করে লেখকের মুনশিয়ানার ওপরে। এটা একেকজন একেকভাবে করে। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। একজনের বই পাঠক লুফে নেয়, আরেকজনের বই টেবিলে পড়ে থাকে। এটা যেন অনেকটা মেয়েদের রান্নার মতো। নিশ্চয় শুনে থাকবে, অমুকের মায়ের হাতের রান্না খুব ভালো। কেন? সকলেই একই মশলাপাতি দিয়ে রান্না করে। তবু একজনের রান্না ভালো হয় কেন? আমার সৈয়দ হক বলতেন, লেখা হচ্ছে গুরুমারা বিদ্যা। সব লেখকের লেখার জন্য হাতের কাছে সবরকমের মশলাপাতিই আছে, তবু কারও বই বেস্টসেলার, আর কারও প্রকাশক মুখে ভেঙচি কাটছেন। সুতরাং এটা কেউ কাউকে বলতে পারবে না। তোমার নিজেকে শিখিয়ে তুলতে হবে। এবং এ জন্য প্রচুর বই পড়তে হবে। নিজের বই না, অন্যের।
- কথাসাহিত্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে আসেনি। আপনি কী মনে করেন? আমরা স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এসেছি।
আনোয়ারা সৈয়দ হক : একটি উত্তপ্ত বস্তু হাত দিয়ে ধরার আগে তাকে ঠান্ডা হতে সময় দিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ মহান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। শুধু মহান নয়, বিস্ময়করও বটে। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন, তার আগে থেকেই কিন্তু বাঙালির সাইকিক প্যাটার্নে একটি পরিবর্তনের মানসিক প্রস্তুতি চলছিল। যুগের পর যুগ নিজের ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত থাকার জন্য বাঙালির মনের ভেতরে পুঞ্জিভূত হচ্ছিল রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ। এবং অন্তরের গভীরে প্রতিশোধস্পৃহা। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে গেলে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন। এখন আমরা যা কিছুই লিখি না কেন, তা হবে শুধু একপেশে বিবরণ। কারণ আমরা যারা নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, আমরা কিছুতেই নিস্পৃহ হয়ে লিখতে পারব না। আবেগতাড়িত হবো আমরা। কিন্তু একজন মহান ঔপন্যাসিককে হতে হবে নিস্পৃহ। হতে হবে মুক্তমনা। তার জন্য সময় দরকার। চিন্তা করো, টলস্টয় কখন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লিখেছিলেন? তাই এখনও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহান সাহিত্য করার সময় আসেনি।
- ২০২২ সাল থেকে কুড়িগ্রামে শুরু হয়েছে ‘সৈয়দ হক মেলা’। বাংলা একাডেমি বা ঢাকা থেকেও হতে পারত।
আনোয়ারা সৈয়দ হক : এ মেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর দেশের মানুষেরা শুরু করেছে। এতে আমার কোনো হাত নেই। তবে হ্যাঁ, আমার এতে উৎসাহ অবশ্যই আছে। ঢাকায় কেন মেলা হয়নি, সেটা তো আমার হেডেক নয়। রাজধানী তো এমনিতেই কবি-সাহিত্যিকদের খেয়োখেয়ির ব্যাপার। সেখানে কে বড় লেখক আর কে ছোট লেখক, এই নিয়ে সর্বদাই মারামারি। আর কারণে অকারণে গ্রুপিং। এসবের ভেতরে কোনোদিন সৈয়দ হক ছিলেন না। আমিও না থাকার চেষ্টা করি। তবে ধরো, মাইকেল মধুসূদন। তাঁকে নিয়ে কি আমরা ঢাকায় মেলা করি? করলেও আমি সেটা জানি না। তবে করা উচিত। এরকম কবি কি আমাদের বাংলা সাহিত্যে আর আসবেন? সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষের হৃদয়ে আসীন হওয়া।
- শিশুসাহিত্য নিয়ে আপনার অনেক কাজ রয়েছে। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অতীত ও বর্তমান তুলনামূলক আলোচনা করবেন কি?
আনোয়ারা সৈয়দ হক : শিশুসাহিত্য নিয়ে কিছু কাজ করেছি। তবে সেটা বড় কাজ কিনা, জানিনে। জানবার ইচ্ছেও নেই। লিখে আনন্দ পেয়েছি সেটাই বড় কথা। অতীতে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে অবিভক্ত ভারতে উজ্জ্বল সব দৃষ্টান্ত আছে। আমাদের এই বাংলাদেশেও আছে। তারা এমন সব শিশুসাহিত্য রচনা করে গেছেন, যা এখনও আমাদের মুগ্ধ করে রাখে! আমাদের বাংলাদেশেও অনেক শিশুসাহিত্যিক ছিলেন, যারা আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে শিশুসাহিত্য করতে হয়। আমরা তাদের দৃষ্টান্ত ধরে এগিয়েছি। এখনই বরং আমাদের শিশুসাহিত্য অতটা দৃষ্টি কাড়ে না। তবে হ্যাঁ, এখন শিশুসাহিত্য লেখার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। আমরা অতি আধুনিক এক যুগে বাস করছি। এখন যন্ত্র এসে শিশুদের মন অধিকার করে নিচ্ছে। এখনকার শিশুসাহিত্য যারা রচনা করবেন, তাদের এদিকে দৃষ্টি অবশ্যই দিতে হবে। না হলে শিশুমনের কাছে এসব লেখা পৌঁছাতে পারবে না।
- জীবনে অর্জিত সাফল্য আপনাকে কি মুক্তি দিল নাকি আরও আবদ্ধ করল?
আনোয়ারা সৈয়দ হক : সাফল্য বলতে কী বোঝাচ্ছ জানিনে। অতি সহজ-সরল ও আপাতকুটিল একটি জীবন পার করলাম। এই জীবনে সাফল্য যেমন এসেছে, ব্যর্থতাও ততোধিক এসেছে। সবকিছুই আমি পরম সাহসে এবং সমাদরে গ্রহণ করতে চেষ্টা করেছি। আমি ঘাড়ে কোনো বোঝা রাখিনি। সব পথের ধারে ফেলে চলে এসেছি। যখন এ পৃথিবী ছেড়ে যাব, একেবারে মুক্ত স্বাধীন হয়ে ফিরে যাব।
- বাংলাসাহিত্যে দ্বিতীয় নোবেল প্রাইজ কত দূর বলে মনে করেন?
আনোয়ারা সৈয়দ হক : এর উত্তর আমি দিতে পারব না। তবে যদি গোপনে আমার কথা শোনো, তাহলে বলতে পারি, সৈয়দ শামসুল হক পেতে পারতেন এই পুরস্কার। যদি আমাদের দেশটি একটু থিতু হতে পারত। দেশের সরকারের কাছে যদি আবেদন করা যেত। তিনি নাটকে এই পুরস্কারটি পেতে পারতেন, যদি তার দেশ লবিং করা জানত। মনে রেখো, এইসব পুরস্কার পেতে গেলে সরকার এবং দেশের মানুষের প্রচণ্ড লবিং দরকার হয়। কিন্তু আমাদের দেশ নানাবিধ কারণে এখন পর্যন্ত শিল্পসাহিত্যের প্রতি ততটা মনোযোগী হতে পারেনি।
- অমর একুশে বইমেলা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন ও পরামর্শ শুনতে চাই।
আনোয়ারা সৈয়দ হক : বইমেলা করা ভালো। বিশেষ করে নতুন লেখকদের জন্য। তাছাড়া নতুন লেখক ও পুরাতন লেখকদের ভেতরে একটা মেলবন্ধনও দরকার। তবে বাংলা একাডেমির ঘাড়ে বইমেলার দায়িত্ব ন্যস্ত করা খুব অন্যায়। বাংলা একাডেমির এ জন্য প্রচুর সময় নষ্ট হয়। একাডেমির অনেক ধরনের উচ্চমার্গের কাজ আছে। একাডেমি বইমেলার জন্য তৈরি করা হয়নি। তাও আগে মেলা ছোট ছিল। এখন মেলার পরিধি এবং পরিসর বিশাল। প্রায় ছয় মাস এ জন্য একাডেমিকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তিন মাস মেলার আগে আর তিন মাস মেলার পরে।
- নতুন কথাসাহিত্যিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আনোয়ারা সৈয়দ হক : এ ব্যাপারে সৈয়দ শামসুল হক সাহেবের যে কথা, আমারও সেই এক কথা। পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। তিনি সারাজীবন শুধু পড়েই গেছেন। এমনকি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থেকেও। একদিকে হাতে কেমোথেরাপি চলছে, আরেকদিকে বই ধরে তিনি পড়ছেন। হাসপাতালের লাইব্রেরিয়ান বইয়ের র্যাক ঠেলে ঠেলে রোগীদের কাছে নিয়ে এলে তিনি পড়বার জন্য বই তুলে নিচ্ছেন। আবার ক্যাফেটেরিয়ায় কফি পান করতে বসে আমাকে পুরনো বই সস্তায় কিনে দিচ্ছেন। বলছেন, সময় হলে এ বইটি পড়ো। খুব ভালো বই। এতসব পড়ার পরেও তাঁর সময় নষ্ট হয়নি। আমি তাঁকে হাসপাতালের নিচ থেকে একটা পুরনো বই কিনে হাতে দিলে তিনি বইটি পড়ে অবাক হয়ে বললেন, এই বইটি আমি ছেলেবেলা থেকে খুঁজছিলাম, আর তুমি এখন বইটা খুঁজে পেলে! তিনি তাঁর মনের মতো করে সাহিত্য রচনা করে গেছেন। জীবন উপভোগ করেছেন। যদিও প্রাণভরে করতে পারেননি, কারণ বিধাতা তাঁকে ততদূর পরমায়ু দেননি। অনেক না দেখা জায়গা, অনেক না লেখা রচনার প্লট তার মাথার ভেতরে নিয়ে চলে গেছেন। আমি যখন ২০১৮ সালে গ্রিস দেশে বেড়াতে যাই, তখন তিনি প্রয়াত; আমি গ্রিসের সেই অনাদিকালের অ্যাম্ফিথিয়েটারের একটা একটা ধাপ পার হয়ে একেবারে উঁচুতে গিয়ে বসি। আর সৈয়দ হককে বলি, তুমি প্রাচীন নাটক এত ভালোবাসতে, আর সেখানে এসে আমি আজ বসেছি। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?
আমার চালচলন ও ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হকের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি উত্তর মেরু, তিনি দক্ষিণ মেরু। তবু আমি এই লেখার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে একমত। লেখক হতে গেলে পড়তে হবে; ব্যস।