ইমদাদুল হক মিলনের জন্ম ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫। বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে, নানার বাড়িতে। লেখালেখি শুরু করেছিলেন ১৯৭৩ সালে। তখনকার ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘চাঁদের হাট’ এ ছাপা হয়েছিল তাঁর প্রথম গল্প ‘বন্ধু’। গল্পটি ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য। পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বড়দের গল্প ‘শঙ্খিনী’। এই গল্প ছাপা হয় কলকাতার ‘সাপ্তাহিক অমৃত’ পত্রিকায়। তার পর থেকে অবিরাম লেখালেখি। বহু স্মরণীয় গল্প উপন্যাস লিখেছেন। বেশ কিছু জনপ্রিয় ধারাবাহিক ও খণ্ডনাটক লিখেছেন টেলিভিশনের জন্য। শিশুসাহিত্যেও তাঁর অবদান অনেক। বাংলাদেশের প্রথম জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি। প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ ১৯৭৬ সালে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায়। সে-ই উপন্যাস সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একাধারে তরুণ-তরুণীদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রচুর প্রেমের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। অন্যদিকে সাহিত্যের মেধাবী পাঠকদের জন্য লিখেছেন ‘নিরন্নের কাল’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’, ‘কালাকাল’, ‘অধিবাস’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘বাঁকা জল’। তারপর ১৮ বছর ধরে লিখলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস তিন পর্বের ‘নূরজাহান’। সাড়ে বারোশো পৃষ্ঠার এই উপন্যাস বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলল। কলকাতার ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ বের করল অখণ্ড ‘নূরজাহান’। তার পর ভিন্ন ভিন্ন চার নামে লিখলেন তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘এমন জনম’। ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’, ‘জিন্দাবাহার’, ‘মায়ানগর’, ‘একাত্তর ও একজন মা’ এই চার উপন্যাস মিলে ‘এমন জনম’। ‘পর’, ‘জীবনপুর’, ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। ২০২৪ সালের পুজোসংখ্যা ‘আনন্দবাজার’ এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস ‘চর কাজলির মানুষ’। এই উপন্যাস ব্যাপক প্রশংসিত। রাষ্ট্রীয় একুশে পদক সহ দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কারে সম্মানিত। তাঁর ‘ভালোবাসার সুখ দুঃখ’ উপন্যাসটি ১৯৯৩ সালের একুশে বইমেলার ২৮ দিনে ৮৭ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ‘সাড়ে তিন দিনের পত্রিকা’র বিশেষ আয়োজন ‘জনপ্রিয় সাহিত্য’ সংখ্যার জন্য ইমদাদুল হক মিলনের সা¶াৎকারটি গ্রহণ করেছেনÑ এহসান হায়দার
- প্রশ্ন : আপনি বাংলা সাহিত্যের এক জন জনপ্রিয় লেখক। ভাবতে কেমন লাগে?
ইমদাদুল হক মিলন: এক সময় নিজেকে জনপ্রিয় লেখক ভেবে খুবই পুলকিত হতাম। পাঠক আমার লেখা পড়ছেন। বইমেলায় অটোগ্রাফের জন্য ভীড়। প্রকাশকদের ব্যাপক আগ্রহ। কোথাও গেলে মানুষ অতিরিক্ত খাতির করে। তরুণ-তরুণীরা ছবি তোলার জন্য আগ্রহ দেখায় এ সব খুবই উপভোগ করতাম। এখন সে-ই অনুভূতি অনেকটাই থিতিয়ে গেছে। এখন শুধু ভাল লেখার কথা ভাবি। মনের মতো একটা লেখা লিখতে পারলে গভীর আনন্দ পাই। ‘নূরজাহান’ নিয়ে কোনও পাঠক তার মুগ্ধতা প্রকাশ করলে ভাল লাগে।
- প্রশ্ন : আপনি লেখক হবেন, এটা কী আপনার পূর্ব সিদ্ধান্ত ছিল? নিজেকে কীভাবে লেখক হওয়ার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন?
ইমদাদুল হক মিলন: লেখক হব এমন স্বপ্ন আমার কখনও ছিল না। আকস্মিক একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার এক তরুণ লেখক বন্ধুকে দেখে মনে হয়েছিল আমিও একটু চেষ্টা করে দেখি, পারি কি না। সে-ই চেষ্টাই এক সময় নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছাপার অ¶রে নিজের নাম দেখার লোভে প্রথম প্রথম লেখালেখি করেছি। ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য। সবই গল্প। কবিতা লেখার চেষ্টা করিনি। পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। কল্পনার একটা জগৎও তৈরি হয়েছিল। লিখতে এসে সে-ই জগৎটা কাজে লাগল। একটা সময়ে বুঝে গেলাম শুধুমাত্র উন্মাদের মতো লিখলেই হবে না, পড়তে হবে। বাংলা সাহিত্যের সব ভাল লেখা, বিদেশি সাহিত্যের ভাল লেখা পড়তে হবে। লেখকদের একমাত্র শি¶ক হচ্ছে ভাল বই। এই শি¶াটা পেয়েছিলাম কবি রফিক আজাদের কাছ থেকে। তাঁর কথা মতো বাছাই করা সাহিত্য পড়তে শুরু করেছিলাম। তত দিনে একটা জেদও চেপে গেছে। আমি লেখক হব। শুরুতে ওই সব প্রেমের গল্প উপন্যাসের জন্য প্রচুর নিন্দামন্দ শুনেছি। ধীরে ধীরে সে-ই নিন্দামন্দ কাটাবার চেষ্টা করেছি।
- প্রশ্ন : আপনার পড়াশোনার বিষয় ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সায়েন্স, তার পর ইকোনমিকস। আপনি বাংলা ভাষার এক জন জনপ্রিয় লেখক। অন্য দিকে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রায় পনেরো বছর। লেখক আর সম্পাদক এই দুটো বিষয় কী সংঘাতপূর্ণ?
ইমদাদুল হক মিলন: পড়াশোনার ¶েত্রে আমার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভালই ছিলাম। ক্লাস নাইন থেকে সায়েন্স পড়েছি। ইন্টারমিডিয়েটের পর বাংলা সাহিত্যে পড়া উচিত ছিল। বাড়ি থেকে বলল, ‘সাহিত্য পড়ে ভবিষ্যতে কিছু হবে না।’ আব্বা মারা গেছেন ’৭১ সালে। দশটি সন্তান নিয়ে মা খুব যুদ্ধ করছেন। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই টিউশনি করতাম। লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢুকব, এ রকম স্বপ্ন। লেখার পোকা মাথায় ঢোকাতে সব এলোমেলো হয়ে গেল। লেখক হিসেবে কিছুটা পরিচিত হওয়ার পর, বহু জায়গায় ব্যর্থ হয়ে লেখাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। ’৮৪ সালের কথা। যেটুকু জনপ্রিয়তা তত দিনে হয়েছে সেটুকু সম্বল করেই লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিলাম। বিশ পঁচিশ বছর শুধুমাত্র লেখক জীবন কাটিয়ে সংবাদপত্রের কাজে ঢুকেছিলাম। আমার জীবনের অনেক কিছুই হঠাৎ করে ঘটে যায়। সম্পাদকও হয়ে গেলাম হঠাৎ করেই। বাংলা সাহিত্যের বহু নামিদামি লেখক কবি পত্র-পত্রিকায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পরিচয়’ পত্রিকাতে কাজ করতেন। ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু লেখক। সন্তোষকুমার ঘোষ, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, সুনীল, শীর্ষেন্দু এমন অনেকেই। বাংলাদেশের প্রধান কবি শামুসর রাহমান ছিলেন ‘দৈনিক বাংলার’ সম্পাদক, পরে প্রধান সম্পাদক। এই একই ঘটনা আমার ¶েত্রেও ঘটেছে। তবে সম্পাদক মানে বিশাল দায়িত্বের কাজ। লেখালেখির ¶েত্রে পুরোপুরি সময় দেওয়া কঠিন। লেখা কিছুটা ¶তিগ্রস্ত হয়।
- প্রশ্ন : জনপ্রিয় সাহিত্য এবং সিরিয়াস সাহিত্য এই দুটো বিষয়কে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইমদাদুল হক মিলন: জনপ্রিয় লেখক হলেই যে তিনি সিরিয়াস লেখক বা ভাল লেখক হবেন না এমন কোনও কথা নেই। আমি দু’জন লেখকের উদাহরণ দিচ্ছি। এক জন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আরেক জন হুমায়ূন আহমেদ। দু’জনেই বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন। আবার সাধারণ অর্থে জনপ্রিয় উপন্যাসও লিখেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’ এ সব খুবই উচ্চ মানের উপন্যাস, কালজয়ী। কিন্তু এই লেখাগুলো পঠিত হয় কম। পঠিত হয় তাঁর ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি। এ ¶েত্রে এক জন লেখক আসলে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যান। তাৎ¶ণিক মনোরঞ্জনের আশায় যে পাঠক বই পড়েন তাঁরা পড়বেন ‘দেবদাস’। আর যাঁরা সাহিত্য পাঠ করে জীবনের অর্থ খোঁজেন, জীবনদর্শন আবিষ্কারের চেষ্টা করেন, একটি জাতির ইতিহাস সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সন্ধান করেন সে-ই পাঠকেরা পাঠ করবেন ‘পথের দাবী’ কিংবা ‘চরিত্রহীন’। এই সব লেখা বহু বহু কাল অতিক্রম করে বেঁচে থাকে। হুমায়ূন আহমেদের ¶েত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘লীলাবতি’ বা ‘ফেরা’ খুব ভাল উপন্যাস। আমি তাঁর যে উপন্যাসটি সবচাইতে পছন্দ করি সে-ই উপন্যাসটির নাম ‘মধ্যাহ্ন’। এই উপন্যাসটির কোনও তুলনা বাংলা সাহিত্যে নেই। ‘মধ্যাহ্ন’র পাঠক আর ‘হিমু’, ‘মিসির আলি’র পাঠক এক নয়। যাঁরা ‘মধ্যাহ্ন’ পড়বেন তাঁরা ‘হিমু’, ‘মিসির আলি’ হয়তো পড়বেন না। জনপ্রিয় তকমা পাওয়া লেখকদের দুর্ভাগ্য যে, তাদের কালজয়ী লেখাগুলো সাধারণ পাঠককে আকর্ষণ করে না। পঠিত হয় কম। তবে পঠিত হয় ধীরে ধীরে। যত দিন যায় ওই সব লেখারই কদর বাড়তে থাকে।
- প্রশ্ন : জনপ্রিয় লেখকরা সব সময়ই নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। এই বিষয়টি নিয়ে যদি কিছু বলেন?
ইমদাদুল হক মিলন: যে লেখক পেশাদার, অর্থাৎ যাকে লিখেই জীবন ধারণ করতে হয় তিনি সব সময়ই চেষ্টা করেন তাঁর লেখা যেন পাঠকপ্রিয় হয়। তাঁর বইগুলো যেন ভাল বিক্রি হয়। কারণ বই বিক্রি না হলে প্রকাশক রয়্যালটি দেবেন না। তিনি জীবন ধারণ করবেন কেমন করে? যদি আমার কথা বলি, তা হলে বলব, এক সময় আমি লেখাটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলাম। ’৮৪ সাল থেকে ক্রমাগত ২৭/২৮ বছর লেখার পয়সার সংসার চালাতে হয়েছে। সুতরাং আমাকে মাথায় রাখতে হয়েছে কোন ধরনের লেখা পাঠক বেশি পছন্দ করেন। কোন ধরনের বই বেশি বিক্রি হয়। তখন ল¶্য করতাম প্রেম-ভালবাসা বিষয়ক বইগুলো বেশি বিক্রি হয়। সুতরাং ওই ধরনের লেখা লিখেছি বিস্তর। কিন্তু এক জন প্রকৃত লেখক শুধুমাত্র পয়সার কথা ভেবেই লিখবেন সেটাও মেনে নিতে পারছিলাম না। যে কারণে প্রেমের গল্প-উপন্যাসের বাইরে গিয়েও অন্য রকম লেখার চেষ্টা করেছি। যখন পত্রিকার চাকরিতে ঢুকলাম, নিশ্চিত আয়ের একটা ব্যবস্থা হল, তখন থেকে পয়সার কথা ভেবে আমি আর লিখি না। যা লিখতে ভাল লাগে তা-ই লিখি। এবং লিখি গভীর আনন্দ নিয়ে।
- প্রশ্ন : আপনি বাংলা সাহিত্যের এক জন অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। গল্প-উপন্যাস, ছোটদের লেখা, প্রচুর জনপ্রিয় টিভি নাটক লিখেছেন। আপনি পাঠকের কাছে নমস্য এক কথাকার। আপনার বিবেচনায় যা দীর্ঘকাল পাঠকের মনে রবে, সে-ই ধারার সাহিত্যের মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করেন?
ইমদাদুল হক মিলন: সে-ই ধারার সাহিত্যই সাহিত্য যা কালের পর কাল অতিক্রম করে যায়। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল ইসলাম। মীর মোশাররফ হোসেন বা শরৎচন্দ্র। তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিক, সতীনাথ ভাদুড়ি বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সমরেশ বসু বা হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই সব লেখকের লেখা কালের পর কাল অতিক্রম করে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সময় অতিক্রম করে যাওয়া অনেক লেখক আছেন। এই ধরনের লেখককেই আমি মাথায় তুলে রাখি। তাঁরাই প্রকৃত অর্থে সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখেন। আমার ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি নিয়ে ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘নূরজাহান’ সময় অতিক্রম করে যাওয়া উপন্যাস।’ যদি তা-ই হয়ে থাকে তা হলে আমার লেখক জীবন ধন্য।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতে আপনার লেখার ব্যাপ্তি কেমন হবে? সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের বাইরেও নিজেকে নিতে চান কীভাবে? বিশেষ করে ভিন্ন ভাষায়?
ইমদাদুল হক মিলন: এক জন লেখক কখনওই এ ভাবে বলতে পারেন না, যে তাঁর ভবিষ্যৎ লেখার ব্যাপ্তি কেমন হবে। আমার বয়সে এসে কোনও কোনও লেখক হয়তো ভাবেন আর অন্তত একটি ভাল উপন্যাস লিখতে চাই বা দশটি ভাল গল্প লিখতে চাই। এটা লেখকের সামর্থ্যরে উপর নির্ভর করে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব বড় লেখকই পৌঁছেছেন। একটা সময়ে প্রবাসী জীবন কাটানো বা প্রবাসী হতে যাচ্ছেন এমন বহু পাঠক আমাকে চিঠি লিখে জানাতেন বা ফোনে বলতেন, প্রবাসে যাওয়ার সময় তারা আমার ‘পরাধীনতা’ বইটা হাতে করে নিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন জাপান প্রবাসী এক পাঠক লিখেছিলেন আমার ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ বইটি প্রায়ই তিনি পড়েন। এই বই নিয়ে তিনি একটা লেখাও লিখেছিলেন। সেখানে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমাদের সবারই বুকের ভিতর একটা গ্রাম রয়ে গেছে।’ ভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছে পৌঁছাবার একমাত্র পথ ভাল অনুবাদ ও বহির্বিশ্বে সে-ই অনুবাদগুলোর বিপণন ও প্রচার। এই একটা জায়গায় বাংলা সাহিত্যের বড় লেখকরা অনেক পিছিয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ লেখক জন্মেছেন, শুধুমাত্র অনুবাদের অভাবে তাঁরা বিশ্ব দরবারে পৌঁছাতে পারেন নি। এ দিকটায় নজর দেওয়া খুব জরুরি।
- প্রশ্ন : লেখকদের জীবনে বহু স্মৃতি জমা হয়। আপনি কী আমাদেরকে একটি আনন্দময় স্মৃতির কথা বলবেন?
ইমদাদুল হক মিলন: এক বিকেলে হাঁটতে যাচ্ছি রমনা পার্কে। মিন্টু রোডের ও দিক দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়া একজোড়া ছেলেমেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছেলেটি মেয়েটিকে আমার ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসটির কথা বলছে। পরিষ্কার শুনতে পেলাম মেয়েটি বলছে ওই উপন্যাস আমিও পড়েছি। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ পড়েই তো তোমার প্রেমে পড়লাম! দু’জনেই হাসছে। উপন্যাসটির লেখক যে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তাকিয়েও দেখল না। এক বার আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দিরে গিয়েছি। গেরুয়া পরা এক পৌঢ় আমার কাছে হাত পাতলেন। দশটা টাকা দিলাম। আমার এক বন্ধু ঠাট্টা করে সে-ই মানুষটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘টাকাটা আপনাকে যে দিয়েছে তাঁকে চেনেন?’ মানুষটি আমার বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইমদাদুল হক মিলনকে কে না চেনে?’
- প্রশ্ন : একটি নতুন গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে কেমন প্রস্তুতি নেন?
ইমদাদুল হক মিলন: এখন আমি আর সংবাদপত্রে কাজ করি না। বসুন্ধরা গ্রুপেই আছি। কাজের চাপ কম। লেখার সময় পাই বেশ। লেখার চেয়ে পড়ি বেশি। যেটুকুই লিখি সময় নিয়ে ভেবে লিখি। ওই ভাবনা চিন্তাটাই প্রস্তুতি।
- প্রশ্ন : অটোগ্রাফ দেওয়ার অনুভূতি কী রকম?
ইমদাদুল হক মিলন: অটোগ্রাফ দিতে ভাল লাগে। গভীর আনন্দ নিয়ে কাজটা করি।
- প্রশ্ন : শিশুসাহিত্যে আপনি অনেক কাজ করেছেন। বাংলাদেশে এই শাখাটিও জনপ্রিয় হতে পারত; কিন্তু একেবারেই অবহেলিত ও গোষ্ঠীবদ্ধ। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
ইমদাদুল হক মিলন: বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য জনপ্রিয় নয় কথাটা ভুল। এই শাখাটি অবশ্যই জনপ্রিয়। মোটেও অবহেলিত নয়। দেশের প্রায় সব বড় লেখকেরই শিশু-কিশোর উপযোগী বহু স্মরণীয় লেখা আছে। আর যদি শিশুসাহিত্য করার জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে শিশুসাহিত্যিকরা লেখালেখি করেন তাতে অসুবিধা কী? আমি বছরে অন্তত দুটো কিশোর উপন্যাস ও বেশ কিছু গল্প লিখি। গত দু’বছর ধরে কলকাতার ‘আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী’তে উপন্যাস লিখছি।
- প্রশ্ন : নতুন দিনের লেখকদের লেখা পড়েন?
ইমদাদুল হক মিলন: নতুন লেখকদের লেখা আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ি। যাঁর লেখা ভাল লাগে তাঁকে খুঁজে বের করি। ফোনে কথা বলি। উৎসাহিত করার চেষ্টা করি।