Homeবুক রিভিউ'সে এক ফলের ঘ্রাণ' কাব্যগ্রন্থে মৌলিকত্বের সুবাস | আমিরুল আবেদিন

‘সে এক ফলের ঘ্রাণ’ কাব্যগ্রন্থে মৌলিকত্বের সুবাস | আমিরুল আবেদিন

জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের বিভাগে প্রথমেই মনোযোগ কেড়েছিলেন জিদান ভাই। তার সাথে আমার স্মৃতি কম; নেই বললেই চলে। অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার ঢঙেই জিদান ভাই সবসময় হাত মিলিয়েছেন। হাসতে কোনোদিন ভোলেননি। তবে ঠিক আন্তরিক সম্পর্ক হয়নি। তবে তিনি যে কবিতা লেখেন এবং অনেক সুন্দর লেখেন, এ কথাটা এক ধরনের মিথ হয়ে ছিল। জিদান ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলোচনার এক অংশে মনে আছে তিনি বলছিলেন, সাহিত্য সমালোচনাকে কিছুটা হলেও যাচাই করা জরুরি। এমন বিনয়ী এক কবির কবিতাই পড়া হয়নি। তবে তিনি যে দীর্ঘদিনই প্রস্তুতি নিয়েছেন তা বোঝা গেল। অবশেষে আব্দুর রহমান জিদান তার কাব্যগ্রন্থ ‘সে এক ফলের ঘ্রাণ’ কবিতার বইটি এলো।

এখনও বাংলাদেশে কবিতা লিখেন এবং অনুভূতিটা ধারণ করেন, এটুকুই কবিতার শক্তিমত্তার জন্য যথেষ্ট। আমি নিজেও এমন পাঠাভ্যাসের মাঝে ছিলাম যে, কবিতা ঠিক পছন্দের জনরা হয়নি। তবে কবিতা একেবারে উপভোগ করি না বললে ভুল হবে। জিদান ভাইয়ের কবিতার বইটির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুটো কপি সংগ্রহ করি। তিনি বই এনেছেন তা জানানওনি। জেনেছি কোনোভাবে। কিনেই পড়া শুরু করলাম। তিনদিন অফিসে যাওয়ার পথে, রাতের আঁধারে, ব্যস্ত সড়কে, অফিসের ব্যস্ততা, অনুবাদের ক্লান্তি—এসবের মাঝে পড়েছি। পড়েছি, মুগ্ধ হয়েছি এবং সমালোচনামুখরও হয়েছি।

আব্দুর রহমান জিদানের পাঠরুচির বড় অংশ জুড়ে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সেই আবহ তার কবিতায় এসেছে। তার শব্দচয়ন পুরোনো ধাঁচের না। কবিতার গাঁথুনিতে তিনি শহুরেভাবে স্মার্ট, আবার তার শব্দে আলাদা ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া আছে। কিন্তু তা এখনও ম্যাচুরিটি পায়নি—বিষয়টি শব্দ শব্দ ধরে আলোচনার প্রয়োজন নেই। তবে এই ম্যাচুরিটি না পাওয়ার মধ্যেই তার সাহিত্যশিল্পীর যে সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে, তা বিশদ করে বলার প্রয়োজন নেই। কবিতা যারা বোঝেন তারা আমার তুলনায় আরও ভালো বলতে পারবেন। তবে তারা কঠোরও হবেন। কঠোর যতোই হোন না কেন, সে এক ফলের ঘ্রাণ আমাদের মৌলিকত্বে নতুন ঘ্রাণ দিয়েছে। লেখকের প্রথম কবিতা থেকেই সেই পুরোনোকে বর্তমানের সঙ্গে সম্মিলনের আগাম বার্তা দিয়েছেন যখন তিনি লিখলেন, ‘আমাদের আদি পিতামাতাদের হতে/ আশীর্বাদ আসে।’—অন্তত এ বাক্যেই। আব্দুর রহমান জিদান তার কবিতায় দৃশ্যকল্পে বিষন্ন নন। চাঁদ, আঁধার আর আদিপিতামাতার ঐতিহ্য বা তার অনুভূতিকে বর্তমানের সঙ্গে সাজুয্য দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। চাঁদের ছবি, রোহিণীর দূরত্ব, পূর্বজ, ভবিতব্য, জোছনা, কাঁটার সঙ্গে সহাবস্থান, শ্মশান, পাথরের শক্ত আভরণে বাঁচা—এসব তার প্রতিটি কবিতায় এসেছে। ভারতীয় ঐতিহ্যকে তিনি যেভাবে নানা কবিতায় এনেছেন, বাংলা সাহিত্যের কবিতা কতদূর পর্যন্ত এসেছে তা সম্পর্কে যে কবি ওয়াকিবহাল—তা এ বইটির প্রত্যেকটি পাতায় এসেছে। নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভাবনায় তিনি ইউরোসেন্ট্রিক ছিলেন। অ্যান্ড্রোমাকে তিনি যেন সোফিস্টদের ভাবনাকে টানলেন, বাবেল টাওয়ার এসেছে। তবে তার মন পড়ে আছে চিরায়ত বাংলায়। বাংলার যে অমূল্য স্থান, শব্দগুচ্ছ এমনকি অভিধা মনিমুক্তোর মতো বহুদিন সিন্দুকে আবদ্ধ ছিল, আব্দুর রহমান জিদান তা ফিরিয়ে এনেছেন।

স্বর্ণমৃগ, মথনী নদীর কথা—বিশেষত এ দুটো কবিতা আমার দারুণ লেগেছে। তাছাড়া কে যেন ঝুলছে, এখানে এসো না, একদিন ভেসে যাবে সব, হয়ে গেছে দেরি—এ কবিতাগুলো কয়েকবার পড়ার মতো। সামান্য আফসোস আবার একই সঙ্গে নতুন কাউকে বাংলাসাহিত্যে আসতে দেখার পুলক—দুটোই কাজ করে মনে। আধুনিক বাংলা কবিতা যতটুকু লেখা হয়েছে ততটুকু যে জিদান ভাইয়ের জানা তা আমি জানি। তার সঙ্গে সরাসরি আলাপ হয়নি, তিনিও আনুষ্ঠানিকতা বাদে কখনই আন্তরিক সৌহার্দ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকেননি। কবিরা এমনই। শুধু পছন্দের কিছু মানুষদেরই আকড়ে রাখেন। তবে কবির সঙ্গে সংলাপ হয়ে যায় কবিতা পড়ে। আমার তা হয়েছে। আব্দুর রহমান জিদানের মন শহরের শামসুর রাহমানের মতো, অনেক মায়াবী স্থানের খোঁজের মেজাজে তিনি জীবনানন্দ দাশ, ভালোবাসার অনুভূতির সরেস আনন্দে তিনি শহীদ কাদরী ও সৈয়দ শামসুল হক, উত্তর-আধুনিক বিষন্নতায় তিনি আবিদ আজাদ, নীতি-নৈতিকতা আর মূল্যবোধের শুদ্ধতার অনুসন্ধানে তিনি এরিক মারিয়া রিলকের মতো, আবার মরমিয়ায় তার শব্দে সুফি আভরণ না থেকে এসেছে স্বাভাবিক শব্দে বৈচিত্র্য, ঈশ্বরের সঙ্গে সংলাপের নৈশব্দ।

এই প্রস্তুতি তিনি দীর্ঘদিন নিয়েছেন বোঝা যায়। তা হতে পারে। কবির প্রস্তুতির সময় প্রয়োজন। তার লেখায় সে ছাপ আসছে। তবে আব্দুর রহমান জিদান এখনও পরিপূর্ণ ও পরিপক্ব কবি এমনটি বলা যাচ্ছে না। কিছু কিছু জায়গায় তার কবিতায় পুরোনো বাংলার কাল্পনিক ঐতিহ্য আনতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্বসূরীর ছাপ টেনে এনেছেন। অনেক পঙ্‌ক্তি দেখা গেছে জীবনানন্দের কবিতা মনে হয়। কোনো কবিতায় তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো। তার কবিতার ম্যাচুরিটি তখন আসবে যখন তিনি পূর্বসূরীদের ভাবনাকে আত্নীকরণ করে নিজস্ব ঘ্রাণ দিতে পারবেন। তবে এটুকু বাদে তার ইতিবাচক দিক, তিনি শব্দকাঙাল নন। এ জেনারেশনের অধিকাংশ কবি ও লেখক কোনো ভারি ও কঠিন শব্দ কবিতায় দিয়ে ভাবেন তারা অনেক অসাধারণ কিছু লিখেছেন। এটুকুই তাদের আনন্দ। কিন্তু আব্দুর রহমান জিদান যখন ভাগীরথী, রোহিণী, ধরিত্রী বলেন তখন তার মেজাজটা বুঝতে পারা যায়। এখানেই তিনি সফল। তার এ শব্দগুলো গ্রামের সেই স্নিগ্ধতাকে কল্পনায় আনে। মেথির ফলের ঘ্রাণ কবিতায় তিনি বলেন,

কেন শীতকালে রাত আসে, বাজে রোজ ট্রেনের বাঁশি,
কুকুরেরা ঘুম ভেঙে ডাকে প্রাণপণ,
শুকতারা চেয়ে থাকে- পুবে
একা একা আজানের শেষ পঙ্‌ক্তিতে।

পাঠক লক্ষ করবেন, একা একা আজানের পঙ্‌ক্তিতে যে সময়ের কথা কবি বলছেন তা খুব পরিচিত এক সময়। ফজরের আজানের ওই সময়ের সাদামাটা বর্ণনা চারটি লাইনে ভিন্ন ও আকর্ষণীয়ভাবে বলার দক্ষতা অধিকাংশ কবির মধ্যেই নেই। হাল আমলে যারা লেখেন তারা এখনও কবিতার নামে লেখেন স্টেটমেন্ট। আর আব্দুর রহমান জিদান আসছেন কবিতায় চিত্রকল্প নিয়ে।

আরেকটি কবিতা ‘তোমার প্রশস্ত বুক’ এর পঙ্‌ক্তি দেখা যাক যেখানে এক জায়গায় তিনি বলেন,
উপগত পিতার কিংবা প্রেমিকার মুখের বাস্তবতার চেয়ে, মূলত যা পিতৃত্ব বা
প্রেমকে ছাড়িয়ে গেলেও,
মানবিক মেনে তবু কেন যেন সহজ লাগে না।

এ বাক্যে কবি কোনোভাবেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে প্রেমকে দেখেননি। কিন্তু পাঠককে যে ছলে ফেলে দেন তা কল্পনার গাঢ়ত্ব ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ এই পিতৃত্ব প্রেমকে শিশুর মতো বা বাবার মতো আগলে দায়িত্বকে আকড়ে রাখার। পুরুষতান্ত্রিকতার বদলে তিনি যেন মায়ের মতোই কমনীয়। কবিতা চর্চায় তার এ ধরনের ভাবনা দারুণ। মোদ্দাকথা, গোটা কবিতাটায় কবি মূলত সব কবিতায় একটা জিনিসই জাহির করেছেন, তার নিজেকে। তিনি ছাড়া আর কেউ ঠাঁই পায়নি। যে অর্থহীন বিনয়ে নিজেকে শক্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছেন তার প্রশংসা করি। এমনকি পূর্বসূরীদের দিকে তাকানোতেও তার যে আগ্রহ সেখানেও মেকিভাব নেই। কিন্তু বাক্যকে বা নিজেকে আত্নপ্রকাশ করতে গিয়ে তিনি কিছুটা লজ্জিতও কি?

এ বছর বইমেলায় ‘সে এক ফলের ঘ্রাণ’ অমূল্য একটি কাব্য সংকলন। তবে বইটির আবেদন নষ্ট হয়েছে এর বাঁধাইয়ে। এমনটি তরুণ এক কবির জন্যও অনেকটা ক্ষতিকর। আমাদের দেশে কবিতার বইয়ের কাটতি এখন বইয়ের প্রচ্ছদ, বাঁধাই আর তার নকশার ওপর নির্ভরশীল। ঐতিহ্য তাদের বইয়ের ছাপানোতে যত্ন নেয়। কিন্তু এ বইটির ক্ষেত্রে তার ঘাটতি দেখা গেছে। বাইন্ডিং ভালো নয়, প্রচ্ছদটিও সঠিক কালারের আউটপুট দেয়নি। বইটি হাতে নেওয়ার পর অপরিচিত কেউ সংগতই দূর্বল ভেবে সরে যাবেন। এমনকি যে বাঁধাই ও কাঠামো বানিয়েছে, সে হিসেবে বইয়ের মূল্যটিও বেশি মনে হবে। তাতে নতুন পাঠক এ দারুণ কাব্য সংকলন থেকে সরবেন। ঐতিহ্য প্রকাশনী এক্ষেত্রে ভালো করতে পারত। অন্তত তরুণ এ কবিকে সামনে উপস্থাপন করায় তারা গ্রুমারের কাজ করতে পারতো। এ জন্য একটু মনও খারাপ হয়েছে। তবে আমাদের প্রকাশনী এমনই।

‘সে এক ফলের ঘ্রাণ’ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলাপের ইচ্ছে ছিল। তা করলাম না। কবিতার এত ব্যবচ্ছেদ করতে নেই। বহুবছর পর একদমই নতুন মেজাজের কবি পেলাম। এখন অনেকেই ঐতিহ্য বা নিজ শিকড়ের খোঁজে যান। তবে আব্দুর রহমান জিদান সেখানে গেলেও অনেকটাই শহুরে ও ইতিবাচক মেজাজের। তার প্রথম কাব্য সংকলন ভবিষ্যতে আরও পড়ার আগ্রহ বাড়িয়েছে। তবে ভবিষ্যতে বইয়ের ফ্ল্যাপ, কাভারের আউটপুট এগুলোও নিজের অমূল্য কবিতার মতো আগলে দেখার অনুরোধ রইলো। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ায় ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে, ভাবি না। এমন আন্তরিকতাও নেই। তবে শুভকামনা রইলো। বিভাগে একজন কবি আত্নপ্রকাশ করলেন। এ আবেগ যেমন বুকে আবেগ জাগিয়েছে আবার দূরত্ব থাকায় তা নিয়ন্ত্রণও করেছি। শুভকামনা।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular