Homeইন্টারভিউআমাদের বইমেলার টার্গেট কিন্তু শুধু বই বিক্রি না বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে প্রমোট...

আমাদের বইমেলার টার্গেট কিন্তু শুধু বই বিক্রি না বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে প্রমোট করা

-প্রকৌশলী মেহেদী হাসান

সৃজনশীল প্রকাশনার প্রতিশ্রম্নতি নিয়ে বাংলাপ্রকাশ আত্প্রকাশ করে ০১ এপ্রিল, ২০০৭-এ। শুরম্নতেই বাংলাপ্রকাশ সৃজনশীল ও মননশীল প্রকাশনার উৎকর্ষ সাধনে সড়্গম এবং বোদ্ধামহলের প্রশংসায় সিক্ত হয়। প্রকাশনার উন্নত মান ও বইয়ের বিষয়বস্তুর জন্য বাংলাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বই বিভিন্ন গুরম্নত্বপূর্ণ পদক-পুরস্কার অর্জন করে। বাংলাপ্রকাশ মনে করে প্রকাশনা মানে পাঠকদের মাঝে ধ্রম্নপদি ও স্মরণযোগ্য বই পৌঁছে দেওয়া। প্রকাশক প্রকৌশলী মেহেদী হাসান-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাপস রায় ও মুজাহিদ বিল্লাহ

……………………………………………………………………………………………………………….

বাংলাপ্রকাশের সূচনা-কথা জানতে চাই। আপনাদের যাত্রাটা কীভাবে শুরু হলো?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : আমরা ৩৭ বছর ধরে প্রকাশনায় আছি। কিন্তু বাংলাপ্রকাশ শুরম্ন করেছি ২০০৭ সালে। আমাদের মূল টার্গেট ছিল শিল্পসাহিত্যের বিকাশ। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করাই আমাদের লড়্গ্য। সব ভালো লেখকের বই আমাদের এখানে আছে। অন্য প্রকাশকরা বইয়ের প্রিন্ট, পাবলিশ করার জন্য লেখকের কাছে টাকা নেয়, আমরা সেটা করি না। আমরা আগে লেখকদের প্রাপ্য সম্মানী বুঝিয়ে দেই, এরপর বইটা কীভাবে হবে এ বিষয়ে পরিকল্পনা করি। এটা প্রথম থেকেই
গুছানো। আমরা চাইলে বইয়ের সংখ্যা পাঁচগুণ বাড়াতে পারতাম কিন্তু কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারতাম না। মেলায় দেখবেন ৪ হাজার বই বের হয়, আসলে ১০০ ভালো বই এনাফ। ১০০ লেখক কিন্তু কম না। বই কিন্তু খুব একটা মারাত¥ক জিনিস! আপনি যদি কোনো দেশের এয়ারপোর্টে বই নিয়ে যান সেখানে কিন্তু আপনাকে ভালোভাবে চেক করা হবে যে বইটা কীসের বই? কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কী বই নিয়ে কোন দেশে ঢুকছেন এটা খুব গুরম্নত্বপূর্ণ। বই অস্ত্রের চেয়েও মারাত¥ক। বই এমন একটা জিনিস যেটার মাধ্যমে আপনি ভালো কিছু পেতে পারেন, অনুপ্রাণিত হতে পারেন, আবার খারাপ কিছু পেতে পারেন। বই একটা সেনসেটিভ
বিষয়, তাই এর মান, মুদ্রণ সবকিছু ঠিকঠাক হতে হবে। বাংলাপ্রকাশ যেসব বই বের করে সেসবের কোয়ালিটি অব প্রিন্ট, কোয়ালিটি অব এডিট বিশ্বমানের।

আপনারা শুরম্ন থেকেই বয়সভিত্তিক বই করছেন। এই ভাবনাটা কেন এলো?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : আমরা শুরম্ন থেকেই সিদ্ধাšত্ম নিয়েছিলাম যে বয়সভিত্তিক বই করব, আসলে শিড়্গাটাই তো বয়সকেন্দ্রিক। শিশুদের বইয়ের ফন্ট আর বড়দের বইয়ের ফন্ট তো কখনও এক হবে না। চিত্র, ইলাস্ট্রেশন সব আলাদা। এখন বাংলাদেশে অনেক আর্টিস্ট
হয়েছে কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশে পাঁচ-সাতজনের বেশি আর্টিস্ট ছিল না। সে সময় তো ইংরেজি বই ট্রান্সলেট করার লোকও কম ছিল। ২০০৭ সাল থেকে আমরা বিভিন্ন বইমেলাতে অংশগ্রহণ করছি এবং বিশ্বমানের যত প্র্যাকটিস আছে সবগুলো আমরা করার চেষ্টা করছি। এখন তো আমাদের আরও নতুন কিছু আসছে। আমরা বয়সভিত্তিক পাবলিশারের দিকে নজর দিচ্ছি।

একুশে বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। প্রকাশকদের একাংশের অভিমত মেলার আয়োজন প্রকাশকদের হাতেই থাকা উচিত। আপনি এই বক্তব্যের সঙ্গে কতটা একমত?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : প্রথম কথা হচ্ছে, এই বিতর্কে যাওয়াই উচিত নয়। বাংলা একাডেমি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে। এই মেলা তাদের একটা অন্যতম ইভেন্ট। এই ইভেন্টের মূল নিয়ামক প্রকাশক এবং তাদের বই। এসব ছাড়া মেলায় যা কিছু আছে সবই হচ্ছে ম্যাটেরিয়াল। লেখক-প্রকাশক-বই হচ্ছে মেলার প্রাণ। আমি মনে করি, শুধু প্রকাশক কেন, একটা বোর্ড হতে পারে, যেখানে সরকারের যারা সাহিত্য প্রমোট করছেন, সংসদীয় কমিটিতে শিল্পসাহিত্য বিষয়ে বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ-প্রাজ্ঞজন যারা আছেন, প্রকাশকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় যারা আছেন; পু¯ত্মক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতিকেও এখানে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এর বাইরেও দেশের প্রথিতযশা শিল্পী, সাহিত্যিক যারা আছেন, অতীতে যারা মেলার সঙ্গে যুক্ত থেকে ভূমিকা রেখেছেন তাদেরও যুক্ত করা উচিত।

বইমেলার পরিসর বাড়ছে। বাংলা একাডেমি থেকে মেলা সরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসা হয়েছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এমনটাও শোনা যাচ্ছে যে, মেলা পুনরায় অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হবে।

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : অনেকেই বলছে যে, মেলাটা এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া যায় কি না? আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি, তিনি বিষয়টিকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেননি। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতির যে সংযোগ, সেটা কিন্তু বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানÑএসব মিলেই। আমি মনে করি না, এখন যেখানে মেলা হচ্ছে, এর বিকল্প জায়গা শহরে আছে। এই মেলাটা কিন্তু শুধুই ‘মেলা’ না। এটা প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। এর কারণ আছে। তাছাড়া, এ ধরনের কথাই-বা উঠবে কেন?

আপনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বইমেলায় ঘুরেছেন। সেগুলো নিশ্চয়ই দারম্নণ অভিজ্ঞতা! আমাদের মেলার সঙ্গে সেগুলোর পার্থক্যটা যদি বলতেন?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : আমাদের বইমেলার টার্গেট কিন্তু শুধু বই বিক্রি না, বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে প্রমোট করা। প্রকাশক হওয়ার সুবাদে
আমি প্রতিবছরই বিভিন্ন আšত্মর্জাতিক বইমেলাতে যাই। আপনি যদি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা দেখেন, সেখানে দেখবেন যে, ওই মেলার সঙ্গে সেই দেশের সরকার সরাসরি সংযুক্ত। যদি আপনি শারজাহ বইমেলার দিকে তাকান, দেখবেন সরকারই সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকার তাদের সহযোগিতা করছে। তারা সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করছে। তারা বুঝতে পেরেছে তেলের টাকা দিয়ে বেশি দূর আর যাওয়া যাবে না। এখন মেধার দিকে আসতে হবে। তারা এখন তেলের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে বর্তমান সময়ে এসে আবুধাবি বা শারজাহ’র বইমেলা ভিন্নরূপে দেখা যাচ্ছে। তাদের মেলা বেশ উন্নত। আমরা যদি দুবাই বা সিঙ্গাপুরকে সবসময় বিচারের মানদ-ে উন্নত বলে তুলনা করি, তাহলে ওদের বইমেলার সঙ্গে আমাদের মেলার তুলনা কেন করব না? তারা যেভাবে কাজ করছে আমরাও সেভাবে কাজ করতে পারি। যেসব দেশ মেধায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সফল হয়েছে, তাদের ফলো করতে পারি, আইডিয়াটা নিতে পারি। বাইরের দেশগুলোর দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় আমাদের কী করা প্রয়োজন?

এখন ডিজিটাইজেশনের কাল। সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে, বাংলা সাহিত্যের বিকাশে আমরা কীভাবে কাজ করতে পারি?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : ইন্টারন্যাশনাল বইমেলাগুলোতে শুধু বই সেলিং না, বইয়ের রাইটস সেখানে অন্যতম গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের বাংলাপ্রকাশ বা দু’একজন পাবলিশারের
রাইটস বাইরে বিক্রি হয়েছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাংলা একাডেমি সবসময় ফোকাস করে এটা একটা মেলা। এটা মেলা না, এখানে রাইটস ট্রানজেকশন হবে, রাইটস কেনাবেচা হবে, বিদেশ থেকে লোক আসবে, আরও ১০০ পাবলিশার আসবে, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। লিটারেচার, পাবলিকেশন্সের বিভিন্ন সেমিনার হবে। মেলাকে আšত্মর্জাতিক রূপ দিতে হবে।

অর্থাৎ একুশে বইমেলার আপনি যে সম্ভাবনার কথা বলছেন, একে একটি আšত্মর্জাতিক রূপ দেওয়ার যে ভাবনা; কিন্তু আমরা তো দেখতে পাচ্ছি মেলায় পাশের দেশের একটি রাজ্য কলকাতা থেকেও প্রকাশকদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না।

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : এটা আমাদের চিšত্মার সীমাবদ্ধতা। আপনি যদি বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে চান তাহলে আপনাকে ইংরেজিতে যোগাযোগ করতেই হবে। বাংলা তো ভারতবর্ষেই শেষ। আপনাকে সাগর-নদী পার হয়ে যোগাযোগ করতে গেলে ইংরেজি জানতে হবে। ইংরেজিকে ছোট করার কিছু নেই। যারা গুণীজন, দেশের বড় বড় মানুষ সবাই কিন্তু একমত যে, সব ভাষাকে সম্মান করতে হবে। এখানে অন্য ভাষার চেয়ে বাংলা গুরম্নত্বপূর্ণ, কারণ এই ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। শারজাহতে মেলায় কথাবার্তা বলে দোভাষী দিয়ে। সেখানে তাদের সব দেখে আমেরিকার লোকেরা। তারা তাদের ব্যবসার মূল বিষয়টা আমেরিকান সিওকে বলে দেয়। সিও অন্যদের
সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে সেটা ঠিক করে। তারা গত ৫ বছরে অনেক দূর গিয়েছে। আমরা যেভাবে ভাবছি, যেভাবে চলছি, এভাবে চললে আমাদের আগামী ২০ বছরেও চেঞ্জ পাবেন না। আপনি ২০০১ সালের আর ২০২৪ সালের মেলার তফাৎ সেভাবে পাবেন না, শুধু মেলার স্ট্রাকচার ছাড়া।

মুদ্রণ এখনও আমাদের দেশে ঘোষিত শিল্প নয়। এ ব্যাপারে আপনারা সরব ভূমিকা নিলেও সরকার উচ্চবাচ্য করছে না। এই সেক্টরে সরকারের কতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : মুদ্রণশিল্প শুধু মেশিনের কাজ নয় এর সঙ্গে আসলে কালি থেকে শুরম্ন করে সাতটা বিষয় সংযুক্ত। এই সাত বিষয় নিয়ে সাতজন কাজ করে। আর পাবলিশার সবাইকে নিয়ে একত্রে কাজ করে। ১৯৭০ সাল থেকে বই হচ্ছে, এটা এখনো কেন শিল্প হয়ে ওঠেনি সেটা আমি বলতে পারছি না। আমি কোনো আমেরিকান বা বিদেশি লেখকের বই ছাপানোর জন্য তাকে সেভাবে সম্মানী পাঠাতে পারছি না, টাকা ট্রানজেকশন করতে পারছি না? এতে আমার কোনো এখতিয়ার নেই। কিন্তু গার্মেন্টসের জন্য কিন্তু এটা একেবারেই ওপেন। তাদের নিয়ম আছে। সেখানে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাপারটা সিদ্ধ। অথচ দেখুন পাবলিশার কিন্তু গার্মেন্টসের অনেক আগের শিল্প।
পাবলিশারদের জন্য ৪০০ একর জায়গা নিয়ে ইপিজেড হওয়ার কথা ছিল সেটা কিন্তু এখনও বা¯ত্মবায়ন হয়নি। এটা কখন হবে? সরকারি পলিসি মেকিং-এ যদি আমাদের লেখক, প্রকাশক থাকে, তারা বিষয়টি তুলে ধরতে পারে। এখানে বাংলা একাডেমি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রকাশনার কাঁচামাল হলো কনটেন্ট। লেখকদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

প্রকৌশলী মেহেদী হাসান : লেখকদের লেখার জন্য বই পড়তেই হবে। আপনি যত বেশি বিশ্বসাহিত্য পড়বেন, যত বেশি বই পড়বেন তত বেশি আপনার লেখার ধার থাকবে। লেখকদের বিশ্বসাহিত্যের চর্চা করতে হবে। একেক ভাষার একেক রকমের মেজাজ রয়েছে। লেখকদের বিখ্যাত বইগুলো যে ভাষার সেই ভাষাতেই পড়তে চেষ্টা করা উচিত।পে দিলাম, এটা করা যাবে না। এরকম কিছু প্রকাশক আছে বাংলাবাজারে, যাদের কিছু টাকা দিলে তারা বই ছেপে দেয়। এ ধরনের প্রকাশকদের জন্যও আমাদের শিশুসাহিত্য অনেক পিছিয়ে আছে।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular