Homeইন্টারভিউশিশুসাহিত্যিকরা ভবিষ্যতের নায়ক তৈরি করেন | আখতার হুসেন

শিশুসাহিত্যিকরা ভবিষ্যতের নায়ক তৈরি করেন | আখতার হুসেন

আখতার হুসেন ছড়াকার, গল্পকার এবং অসামান্য গীতিকার। জন্ম ১ নভেম্বর, ১৯৪৫ সালে, নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার নুরুল্লাপুর গ্রামে। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
গদ্য-পদ্য মিলিয়ে প্রকাশিত বই ৬০’র বেশি। ও হাওয়া ও হাওয়া, সেই যে আমার প্রাণের মিতে নদী, রিমঝিম আর পরিদের দেশে যাবে না, কুট কুট কুট্টুস ফুট ফুট ফুট্টুস, আমার দুটো ডানা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তারই লেখা গান প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’-এর সংগঠন সংগীত। গুণী এই শিশুসাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন এহসান হায়দার

আপনার শিশুসাহিত্য চর্চার শুরুর সময়টা কেমন ছিল?

আখতার হুসেন : আমি বড়দের সাহিত্য দিয়ে শুরু করি এবং তার পরেই নিজেকে ডাইভার্ট করি রূপকথা লেখার দিকে, ছড়া লেখার দিকে। আমরা গফরগাঁও থেকে বদলি হয়ে আসি শ্রীমঙ্গলে, সেখানেও এসে ছড়া লিখি, পত্রিকায় পাঠাই কিন্তু ছাপে না। এরপরে যখন কুলাউড়াতে চলে এলাম, তখন একটা লেখা পাঠালাম অর্ধ-সাপ্তাহিক বাংলা নামক পত্রিকায়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো, পত্রিকাটার ছোটদের পাতা দেখতেন দাদুভাই (রফিকুল হক)। আমার লেখাটা পাঠানোর ঠিক পরের সপ্তাহে ছাপা হয়ে গেলÑআমি এবারে দুই হাত ছড়িয়ে লিখতে শুরু করে দিলাম। আমার বন্ধুবান্ধব যারা ছিল তারাও খুব আনন্দিত হলো। তারপরে এই যে ছড়া লেখা শুরু করলাম, আর থামিনি। এরপর থেকে আমার শিশুসাহিত্য লেখা শুরু হয়ে গেল।

লেখকদের মধ্যে কার কার লেখা পড়ে আপনি প্রেরণা পেতেন?

আখতার হুসেন : আমার খুব ভালো লাগত রফিকুল হক দাদুভাই, মোহাম্মদ মোস্তফা, মো আবদুল মান্নান, নিয়ামত হোসেন, তারপর হোসনে আরা, হেলেনা খান, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, কাজী রাশীদ আনোয়ারÑওনারা খুব ভালো লিখতেন। তারপর এখলাসউদ্দিন আহমদ লিখতেন, আবার আলী ইমামÑআমার চেয়ে বয়সে ছোট কিন্তু তার লেখা আমার বেশ ভালো লাগত। এমন আরও অনেকে আছেন, সবার নাম বলে শেষ করা যাবে না। মাহমুদউল্লাহ তখন নতুন লেখালেখি শুরু করেছে। তাকে এখনও বাংলা একাডেমি পুরস্কারটা দেওয়া হলো না, এটা বেশ দুঃখজনক।

শিশুসাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে একজন লেখক যেমন নিজেকে তৈরি করেন, তেমনি সমাজের নানান কিছু পরিবর্তনও করেন তিনি; বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আখতার হুসেন : লেখার মধ্য দিয়ে শুধু না, সমাজ পরিবর্তনে আমরা কিন্তু সরাসরি যুক্ত ছিলাম। খেলাঘরে যখন লেখা শুরু হতে থাকল, আমরা ততদিনে ঢাকা চলে এসেছি। আর পাতাবাহার বলে একটা পত্রিকা বের হতো তখন। আমরা খেলাঘরের সাথে যুক্ত হলাম আর সংগঠন গড়ে তুললাম। শুধু লিখতাম না, নাচ, গান ইত্যাদি তৈরি করতাম। সারাদেশে আমরা খেলাঘর গড়ে তুললাম এবং ফুটবল টুর্নামেন্ট, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করতাম আর পাশাপাশি লেখা ছাপা তো হতেই থাকত। নতুন যারা লিখত তাদের লেখা ছাপা হতো, এখনও কারো কারো সঙ্গে দেখা হলে এসব মনে পড়ে। তখন পাতা দেখতাম আমি আর এক বন্ধু। ভালো কোনো লেখা পেলে তা এনে ছাপার ব্যবস্থা করতাম আমরা। আর অন্যদিকে তো কচিকাঁচার আসর ছিলই। তারাও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করত। আর মুকুলের মেহফিলের কথা মনে পড়ে, আমাদের যারা অগ্রজ ছিলেন যাদের অনেকে এখন বেঁচে নেই, তারা মুকুলের মেহফিলে যেতেন। সম্মেলন করা, গান করা, চর্চা করা আর লেখালেখি তো আছেই। এর মধ্যেই ছিলাম আমরা।

আপনাদের সময়ে তো বই এত সহজলভ্য ছিল না, আজকে যেমন চাইলেই পরদিন বিদেশি বইও পাওয়া যায়।

আখতার হুসেন : না না এটা কিন্তু ভুল! তখন তো বাংলাদেশ ছিল না, পাকিস্তান ছিল আর দেশের লোকজন বেশ ডিপ্রেসড ছিল। তবু বই চেয়ে চিঠি লিখলেই বই পৌঁছে যেত। আমি বাংলাবাজার থেকে চিঠি দিয়ে এমন বই কিনেছি অনেক। এখন যেমন বই পাওয়া যায়, তখনও পাওয়া যেত। ইংরেজি বই পাওয়া যেত মহিউদ্দিন এন্ড সন্স-এ। যেকোনো ইংরেজি বই পাওয়া যেত। আর এখন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে অনেক কিছু সহজ হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, যার জন্য বই পাওয়া যায় সহজে; কিন্তু সেসময় এত সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যত ভালো ভালো কাজ হয়েছে তা আর এখন হয় না।

শিশুর বিকাশে শিশুসাহিত্য ভূমিকা রাখে; এই বিষয়ে আপনার থেকে জানতে চাই।

আখতার হুসেন : এক্ষেত্রে আমি বলব, প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে হাই স্কুল পর্যন্ত যে বই দেওয়া হয় এবং তাদেরকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যে শিক্ষক বা অভিভাবক থাকার দরকার ছিল তাও কিন্তু কমে গেছে। এর পেছনে একটা কারণ আছে, আমাদের সময়ে কিন্তু বাধ্যতামূলক ছিল দুইটা বই পড়তে হবে এমন। স্কুলেই ছিল এটা, এখন এটা নেই। তারপর কলেজেÑ আনন্দমোহন কলেজেও তাই ছিল। দুর্লভ সব বই আর কত যে বইÑবলে বোঝানো যাবে না। এখন যদিও কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে এই অভ্যাস, তবে সঠিকভাবে বই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর কাজ হচ্ছে না।

শিশুদের বইÑপাঠ্যবইয়ের বাইরে যা আছে সেসব কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

আখতার হুসেন : দেখুন এখানে বয়সভিত্তিক একটা ব্যাপার আছে। শিশুদের পড়া এবং লেখা কিন্তু বয়সভিত্তিকÑসে বাক্য লেখে সেইভাবে। একটা ছোট ছেলে, যার বয়স পাঁচ বছর, সাত বছর, পড়তে শিখছে মাত্র, তার জন্য লেখা বইয়ের বাক্য জটিল হলে চলবে না। যেমন ‘নিশ্চিত’ এর মতো শব্দ লেখা যাবে না। বাক্য হতে হবে ছোট, যেন তার দম আটকে না যায়। বয়স বিবেচনায় বই ছাপার যে প্রক্রিয়া, সেটা আমাদের দেশে কেবল শুরু হয়েছে। আরেকটা কথা, আমাদের দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোতে সম্পাদক নাই, হাতেগোনা দুই-একটা প্রকাশনাতে সম্পাদক আছে। এটা থাকলে হয় কি, বাচ্চাদের জন্য প্রকাশ হওয়া বইগুলো আলাদা যত্ন পায়।

গল্প, রূপকথা দাদি-নানি, মায়েদের থেকে শুনেই শিশুরা বড় হয়, তারপর নিজেরা পড়তে শুরু করে। এই যে গল্প-রূপকথার প্রতি শিশুদের এত ঝোঁক, তার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

আখতার হুসেন : শিশুরা সবসময় কল্পনার রাজ্যে যেতে চায়। তারা বিচরণ করে অজানা দেশে। সেজন্য রূপকথার প্রতি তাদের আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। তারা যখন সিন্দাবাদের রূপকথা পড়ে কিংবা জাপানি রূপকথা পড়ে, তখন কিন্তু তারা কল্পনায় ভাসে। বাস্তবের গল্প পড়তে যে পছন্দ করে না তা কিন্তু নয়, বাস্তবের গল্প পড়তেও ভালোবাসে। এইখানে আমার কিছু কথা আছেÑবয়সভিত্তিক বই প্রকাশের যে বিষয়টা অর্থাৎ বয়স অনুযায়ী বইয়ের যে ব্যাপারটা, এটা আমাদের দেশের প্রকাশকদের মধ্যে এখনও প্রবলভাবে কাজ করছে না। হালকা হালকাভাবে কাজ করছে। কিন্তু এটা কিন্তু খুব সিরিয়াস ব্যাপার। কারণ শিশুসাহিত্যিকরা ভবিষ্যতের নায়ক তৈরি করেন, বিশ্বের মানুষদের তৈরি করেন; তাদের প্রতি যদি আমরা যত্নশীল না হই, তাহলে দেশের কী হবে, তারা সুনাগরিক হবে কী করে! সে জায়গায় যত্নশীল হওয়া জরুরি প্রয়োজন।

আমাদের শিশুসাহিত্যের অভাবের দিকটা বলবেন?

আখতার হুসেন : আপনার এই প্রশ্নটা সকল প্রশ্নের বাইরে একেবারেÑআমাদের শিশুসাহিত্যে একটা অভাব আছে। যেমন ধরুন, আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবÑযারা বড়দের সাহিত্যচর্চা করেন, তারা ছোটদের জন্যও সমানতালে লিখে চলেছেন। ভূতের গল্প লিখেছেন, রহস্য গল্প, গোয়েন্দা গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি লিখেছেন। আমাদের এখানে ভূতের গল্প, হাসির গল্পের খুব অভাব। হাসির গল্প তো আপনি খুঁজেই পাবেন না বলতে গেলে। সে জায়গায় আমাদের শিশুসাহিত্যিক যারা আছেন, তাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। নতুন যারা এসেছেন, তাদেরও দায়িত্ব নেওয়া উচিত, দুই-একজন দিয়ে এটা হবে না। বড়দেরও মনোযোগ দিতে হবে।

সে সময়ের কারও গল্প সম্পর্কে বলতে পারেন?

আখতার হুসেন : আমার এখনও একটা গল্পের কথা মনে আছেÑএকটা হাসির গল্পÑ‘রেকর্ডভঙ্গ’; সেখানে একটা চরিত্র ছিলÑফেলু মামা। নিয়ামত হোসেনের লেখা গল্প; তিনি যেমন হাসির গল্প লিখেছেন, তেমনি সিরিয়াস সাহিত্যও নির্মাণ করেছেন। ছড়া, ভূতের গল্প, রম্যকাব্য সবই লিখেছেন। সেই নিয়ামত হোসেনকে কেউ আর তেমন স্মরণ করে না। মোদ্দাবের হোসেন, আতোয়ার রহমান, হাবীবুর রহমানকে এখন কে স্মরণ করে? সেইখানে আজকে কাউকে কেউ স্মরণ করে না। উনিই প্রথম জমজমাট হাসির গল্প লেখেন বাংলাদেশে। এইরকম আরও অনেকের বই, যেমন এখন মনে পড়ল গোলাম রহমানের কথা। তাদেরকে তো আমরা কেউ স্মরণ করি না। এই হচ্ছে আমাদের দশা। ছোটদের জন্য কয়টা মাসিক পত্রিকা বের হয় বলুন! টইটুম্বুরটা কেন জানি জনপ্রিয় হতে পারেনি। এমন করে আরও অনেক পত্রিকা জনপ্রিয় হতে পারেনি কেন জানি। এখন আমাদের কাছে মাসিক পত্রিকা কয়টা আছে, আমি তো খুঁজলে পাই না তেমন।

শিশুসাহিত্যে আপনার প্রিয় বইগুলোর নাম বলবেন।

আখতার হুসেন : এটা তো কঠিন হয়ে গেল, কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি এমন হবে। ছোটবেলায় আমাকে বাইরের বই দেওয়া নিষেধ ছিল। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, খুব সহজ ভাষায় লেখা দাসপ্রথা উচ্ছেদের ওপর একটা বই বেশ ভালো লাগল। নাম মনে করতে পারছি না এখন। আর আমি আসলে কার নাম বলব, আপনি আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। হাবীবুর রহমানের লেখাÑলেজ দিয়ে যায় চেনা, বনমোরগের বাসা। আগডুম বাগডুম আমার খুব পছন্দের বই। সুফিয়া কামালের ছড়ার বই ইতল-বিতল আমার খুব পছন্দের। আর প্রিয় বইয়ের নাম বলা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, কারণ প্রথম আমাকে আমার বাবা যে বই দিয়েছিলেন সেটার নামই তো আমি মনে করতে পারছি না।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular