কথাশিল্পী ও গবেষক আকিমুন রহমান জন্মগ্রহণ করেছেন ১৪ জানুয়ারি ১৯৬০ সালে, নারায়ণগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি। পেশায় শিক্ষক আকিমুন রহমান দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে। কথাসাহিত্য, গবেষণা ও শিশুসাহিত্যে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যেমন : আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ, বিবি থেকে বেগম, সোনার খড়কুটো, পাশে শুধু ছায়া ছিলো, পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি, এইসব নিভৃত কুহক প্রভৃতি। আকিমুন রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাশেদ সাদী, নুসরাত নুসিন ও তৌহিদ ইমাম।
- শিশু-কিশোরদের জন্য আপনার লেখা বই ‘সোনার খড়কুটো’ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখার ভাবনাটা কীভাবে এলো?
আকিমুন রহমান : এটা খুব কৌতূহল উদ্দীপক এবং আমার জন্য এখনও বেশ চাঞ্চল্যকর বিষয় যে, আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম; একদম বাল্যকাল থেকে, এত সুলভ ছিল হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন; একটা খুব দুর্লভ বই বাবা আমার জন্য যোগাড় করেছিলেন, অনেক বছর আগে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে, এন্ডারসনের রূপকথাগুলোর নাম ছিল ‘অপরূপ রূপকথা’, সেটা পড়তে পড়তে আমি বড় হয়েছি। বাংলা রূপকথাগুলোর আগে আমি হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের অনূদিত রূপকথা দিয়ে বেড়ে উঠছিলাম। উঠতে উঠতে চিরকাল ধরে মনে হতো আমার, আমি আসলে এন্ডারসনের মতো বাচ্চাদের জন্যই লিখব এবং যখন আমি পিএইচডি করছি বড় হয়ে, তখনও আমার মনে হয়েছে, আমি বাচ্চাদের জন্যই লিখব, বড়দের জন্য লিখব না। ফলে চিরকাল ধরে আমার যে ‘সোনার খড়কুটো’র গল্পগুলো রয়েছে, লক্ষ করলে দেখা যাবে যে তার ভেতরে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের প্রভাব রয়েছে। নানা ভাবনা, একদম সাধারণ ঘাস, লতাপাতা, একটা মুরগিছানা—এগুলো কিন্তু এন্ডারসনের একটা প্রভাবজাত। তাহলে আমার শিশু-কিশোর গল্পকার হয়ে ওঠার ও গল্প লেখার প্রেরণার একমাত্র নাম হচ্ছে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন। আমি যখনই ইউরোপে যাই, প্রসঙ্গত বলি, আমার ইউরোপে যাওয়ার একমাত্র বাঞ্ছাই থাকে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে যাব, এন্ডারসনের কবরের পাশে অন্তত একটা বেলা, অন্তত তিন-চার ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকব। কেননা হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন আমার প্রথম প্রেমও বটে।
- এখন পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে?
আকিমুন রহমান : আগের ধারাবাহিকতায় বলি, ‘সোনার খড়কুটো’র গল্পগুলো লিখে উঠলাম, ক্রমে ভেতর থেকে এন্ডারসনের জন্য প্রেম এবং এন্ডারসনের মতো হয়ে ওঠার আবেগটা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেল। আমি বড়দের জন্য লেখার ভেতর ঢুকে গেলাম। ভুলে গেলাম যে একদা কিশোর গল্প লিখিয়ে হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম, কিশোরদের জন্য গল্প বলতে চেয়েছিলাম। এই ব্যাপারগুলো আমার ভেতর থেকে লুপ্ত হয়ে গেল। গবেষণা আমাকে টেনে নিলো। আমি অংশত হচ্ছি গবেষক। অংশত হচ্ছি কথাকার, গল্প বলতে ভালোবাসি। আমি ভুলে গেলাম কিশোরদের জন্য কীভাবে গল্প লিখতে হয়। ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে একজন এলেন, যাকে আমি বলি দেবদূত, আসলে দেবদূত না হলে এইরকম চাপ দিয়ে আমাকে কেউ বলতেন না, যে কিশোরদের জন্য ‘সোনার খড়কুটো’ লিখেছিল, সে কিশোরদের জন্য আর লিখবে না এটা হয় না। তখন করোনা চলছিল, বললাম, না আমি আর এই গল্প লিখে উঠতে পারব না। আমি আর এই পৃথিবীতে নেই। আমি এখন বড়দের জন্য লিখি। সে আমাকে বলল, আপনাকে লিখতে হবেই। সেই চাপের চোটে কিছুটা ভয়, কুণ্ঠা, অস্বস্তি কাজ করছিল। এরকম চাপ দিচ্ছে কেন? আমার ভালো লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে এটা তো ভীষণরকম চ্যালেঞ্জ। দেখা যাক না। তারপর একটা লেখা লিখে উঠলাম। এটা বেরোলো ২০২২ সালে ‘ধানশালিকের দেশ’-এ। ‘ধানশালিকের দেশ’-এ লেখাটা ছিলÑপানিডাঙা গ্রামে যা কিছু ঘটেছিল। সেই ছেলেটি জানাল, এই গল্পটি যেই পড়েছে সেই বলেছে, এই গল্পটি হচ্ছে আমার। আমি হচ্ছি জুলহাজ আলী। দেবদূত শামস নূরও বলছে আমি জুলহাজ। জুলহাজ আলীর এই যে পানিডাঙা গ্রাম, এটা হচ্ছে আমাদের আদি বাংলাদেশ। এরকম সাধারণ পাঠক যখন বলছে তখন আমি বুঝতে পারছি যে, আমি গল্পটা শিল্পসম্মতভাবে বলে উঠতে পেরেছি। তখন ওটা যখন লিখে উঠলাম, তখন ও বলল আমাকে আরও একটি অ্যাখ্যান দিতে হবে, তখন আমার মনে হলো আরেকটা নয় কেন। যে বাংলাদেশ আমাদের জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আমাদের যে বৃক্ষময় গ্রাম ছিল, নদীর ভাঙনে কত কত গ্রাম ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে, এই যে আমাদের বাস্তবতা, মূল শিকড়টা আছে যেখানে, সেখানের বাস্তবতায় সেই গল্পটাকে বলা দরকার আছে। আমার রক্তের ভেতরে চাঞ্চল্য আছে। তখন আমি লিখলাম চিরকালের এই রূপকথা। যেটি এ বছর এপ্রিল-মে-জুন সংখ্যায় বেরিয়েছে ‘ধানশালিকের দেশ’-এ। এই হচ্ছে আমার মোট শিশুকীর্তি। মোট তিনটা বই বেরিয়েছে।
- শিশু-কিশোর সাহিত্য সবসময় পড়া হয়?
আকিমুন রহমান : নিশ্চয়ই। সবসময়। দেশে যখন থাকি, দেশের বাইরেও যখন যাই, যে কয়েকটা বই আমার সঙ্গে থাকে তার ভেতরে হচ্ছে ময়মনসিংহ গীতিকা, দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের দুটো রচনাবলি। কারণ আমাকে পড়তে হয়। যখনই মানসিকভাবে বিকল হয়ে যাই, যখন জীবন একদম শুকিয়ে আসে, তখন আমার জন্য করুণাধারা হয়ে আসে রূপকথাগুলো, ময়মনসিংহ গীতিকা। আমি বরাবরই এন্ডারসনের সঙ্গে থাকি। আমি যখন পোস্ট ডক করতে গিয়েছিলাম জার্মানিতে, আমার বিষয়টা ছিল একটা তুলনামূলক আলোচনা। ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলির সাথে গ্রিম ভাইদের রূপকথার একটা তুলনামূলক আলোচনা।
রূপকথা থেকে উপাদান নিয়ে আরও কোনো কাজ করার ইচ্ছে আছে?
আকিমুন রহমান : রূপকথাগুলো কোনো না কোনোভাবে যেকোনো লেখককে প্রভাবিত করে। কোনো লেখকই এমন নয় যে তিনি উপর থেকে একটা গল্প পান, যার মতো বিশুদ্ধরকম মৌলিক গল্প আর নেই। মূলত পৃথিবীর গল্পগুলো বলা হয়ে গেছে। এখন আমরা ক্রমাগত একজন আরেকজনকে দিয়ে প্রভাবিত হই। কোনো না কোনোভাবে একটি বাক্য, পঙ্ক্তি দিয়ে বা গল্পের অভিযান দিয়ে। যেমন আমি ভীষণভাবে প্রভাবিত হই গিলগামেশকে দিয়ে, নিত্যনবরূপে। গিলগামেশ যে অমরত্বের সন্ধানে বেরিয়েছে, গিলগামেশ হচ্ছে আমাদের আদিতম মহাকাব্য, যেটি মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া গেছে এবং যেটা ক্রমাগত আধুনিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সেই গিলগামেশের যে অমরত্বের সন্ধানে বেরিয়ে যাওয়া এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা, যেটা মানুষের অমরত্বের অভিযানে যাওয়া। আমরা তো বেরিয়ে পড়ি কোনো কিছুকে অর্জন করার জন্য এবং আমরা কি সবসময় সফল হই? হই না কিন্তু। অসংখ্য ব্যর্থতা আছে। আমরা ভেঙে পড়ি, নুয়ে পড়ি এবং সে ক্রন্দনের মধ্য দিয়ে মানবজন্ম যাপন করি। এই যে প্রভাবগুলো, তা কোনো না কোনোভাবে থাকে এবং এই রূপকথাগুলোর প্রভাবে আমি যে বড়দের জন্য লিখছি, সেইসব লেখাতেও এসে যাচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আগামীকাল একটা লেখা লিখতে বসব আর এই রূপকথারই প্রভাব আমার মধ্যে আছে এটা প্রতিপন্ন করতে হবে আমাকে তা কিন্তু নয়। তবে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবগুলো কাজ করছে, যে গল্পগুলো তারা শুরু করেছেন, গল্প বলার যে ভঙ্গিটা, ময়মনসিংহ গীতিকার গল্প বলার যে ভঙ্গিটা, মানে কবিতার মধ্য দিয়ে যে বন্দনারীতি, এগুলো দিয়ে কম আর বেশি আকিমুন রহমান প্রভাবিত হয়ে আছেন বা হচ্ছেন বা আবার নতুন করে হবেন।
- যারা শিশু-কিশোর সাহিত্য লিখছেন, তাদের আলাদা করে প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার আছে কি না?
আকিমুন রহমান : অনেক দরকার আছে। অনেকেই আছেন যারা একটা ধারায় লিখছেন, নগরকেন্দ্রিক গল্প বা কারও হয়তো মনে হলো এখন রহস্য রোমাঞ্চ অভিযান বিষয়ক একটা লেখা শুরু করব এবং সবাই মিলে ভাবছেন যে এভাবেই লিখতে হবে এবং অন্যরা তার পেছনে পেছনে ছুটছেন। আমার যেটা মনে হচ্ছে পড়তে পড়তে, আমাদের এখানকার যারা তাদের আরেকটুখানি নিজের মৌলিক বিষয়বস্তু খুঁজে বের করা দরকার। নিজের একটা স্বাদু ও আরেকটু প্রাণবন্ত প্রাণস্পর্শী একটা গদ্যরীতি শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি করা এবং গল্প বলে ওঠার, নিজেদের মৌলিক করে জাগ্রত করে তোলাটা দরকার। কারণ আমরা যতই বলি না কেন, অনেক লেখক আছেন, আমি অনেককেই পড়ছি কিন্তু কাউকে দিয়ে চমৎকৃত হচ্ছি না। আমি পাঠক। আমার বয়স যাই হোক না কেন। যেকোনো পাঠকেরই কিন্তু চমকিত হতে পারার একটা দাবি আছে। এটা তার অধিকার। আমার জন্য যে লেখক গল্পটা নিয়ে আসবেন, তিনি যে ভঙ্গিতে বলবেন তা আমাকে ভাবাবে এবং বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সেই গল্পটা ভাবিয়ে তুলবে এবং আমি তাকে দিয়ে প্রতিমুহূর্ত অনুপ্রাণিত হব। এই প্রস্তুতিটাতে বোধ হয় একটু কমতি আছে বা আমার বিষয়বস্তু অন্যের বিষয়বস্তু থেকে যে ভিন্ন হতে পারে এই বোধটাও বোধ হয় আর তেমন করে সাড়া জাগাচ্ছে না। এরকম একটা পরিস্থিতি লক্ষ করেছি আমি।
- আপনি তো গবেষণা করেছেন। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুতোষ রচনা এসব লিখেছেন। মোটামুটি অনেকগুলো শাখায় কাজ করেছেন। তবু কোনো একটি নির্দিষ্ট শাখায় কি কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
আকিমুন রহমান : হ্যাঁ করি। কখনও কখনও আমার মনে হয় যে, যখন জীবন সত্যিকার অর্থেই শুকিয়ে আসে, তখন মনে হয় আমার গদ্যগুলো যথেষ্ট প্রাণবন্ত নেই, যথেষ্ট তাজা নেই। এরকম যখন হয় তখন আমার মনে হয়, এখুনি আমাকে গবেষণায় চলে যেতে হবে। ব্যাখ্যা-ভাষ্য তন্ন তন্ন করে রচনা করতে হবে। আবার ব্যাখ্যা ভাষ্যে যখন থাকি তখন আমার মনে হয় গল্প বলতে হবে, গল্প বলতে না পারলে, আর কীই বা জানি। তার মানে আমাকে মননশীলতাও টানে প্রচণ্ডরকমভাবে, সৃষ্টিশীলতাও টানে প্রচণ্ডরকম।
- সাড়ে ৩ দিনের পত্রিকা সম্পর্কে শুনতে চাই।
আকিমুন রহমান : সাড়ে ৩ দিনের পত্রিকাটা চোখেই পড়ত না, যদি আমি না যেতাম। আমি যে প্রকাশনা সংস্থায় বসে ছিলাম সেখানে অন্যদিন নাকি যায়নি কখনও, আমি যেদিন মেলায় গিয়েছি একটি ছেলে ধপাস করে ওখানে রেখেছে। আমি পত্রিকাটা নিলাম, কাগজটা খুব ঝকঝকে। আমার একটা ধারণা ছিল, ঝকঝকে কাগজে বর্জ্র উৎপাদিত হয়। ঝকঝকে কাগজে সিরিয়াস এবং সত্যিকার কাজ হয় না। ভ্রু কুঁচকে তারপর ওটা নিয়েছি। তারপর পড়া শুরু করলাম। তারপর দেখলাম যে, কী আশ্চর্য, এটা তো একটা অসাধারণ কাজ। সত্যি বলছি, আমি মুগ্ধ। বইমেলায় যে ক’টা সপ্তাহ থাকে, একটা করে বেরোক, চারটা বেরোক। কিন্তু এমন যেন বেরোয়। এমন মাগনাই যেন মানুষের হাতে দেওয়া হয়। মানুষ যেন এটার সৌন্দর্য ও গভীরতা দিয়ে আপ্লুত হতে পারে। আমি আপ্লুত হয়েছি। একবছর ধরে ওকে আমি ভুলি নাই। পাবলিশারকে বলেছি, ওদের চিন্তাটা তুমি নাও। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। এটা খুব অসাধারণ কাজ। অভিবাদন জানাই।