আনিসুল হক। কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। কলামিস্ট হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর লেখা ‘মা’ উপন্যাসটি দুটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নুসরাত নুসিন
- ফাল্গুন মাসের সঙ্গে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি অর্জনের আবেগ জড়িত। তারও আগে থেকেই ফাল্গুন মানেই বসন্তদিনের সূচনা। এই ফাল্গুনে কেমন লাগে?
আনিসুল হক: ফাল্গুন এলে মন উড়ুউড়ু হয়, এটা সত্য কথা। তবে বসন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঋতুÑ বিষয়টা এরকম না। বর্ষাকালেই বাংলাদেশ সবচেয়ে সুন্দর। তখন গাছপালার পাতাগুলো খুব সবুজ হয়ে থাকে। নদী-খাল সব জলমগ্ন থাকে। মাঠ-ঘাট সবুজ থাকে। গাছের গায়ে ধূলি কম থাকে। কিন্তু শীতকাল ও বসন্তকালে অনেক ধুলা ওড়ে। কবিরা লিখে লিখে বসন্তকালকে মহিমা দান করেছেন। কারণটা সম্ভবত ফুল। হয়ত বসন্তের সঙ্গে আমাদের মিথের কোনো সম্পর্ক, কাম ও প্রেমের কোনো সম্পর্ক রয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ নেই, তবে মিথলজিক্যাল কারণ রয়েছে। বসন্ত শীতপ্রধান দেশের খুশি হওয়ার ঋতু। গরমে সন্ধ্যার পরে যে দক্ষিণা বাতাস বয়ে যায় সত্যি ভালো লাগে। কোকিলের ডাক শোনা যায়। খুব ভালো লাগে আমের মুকুল ও সুবাস। সবমিলিয়ে কবিরা যখন বসন্তের বন্দনা করেছেন, তখন বসন্তের নিন্দা করাটা সঙ্গত হবে না।
- আপনি বর্ষা-বন্দনা করলেন। তবে কবিতাতেই বসন্ত স্থায়ী আসন পেয়েছে। কবিদের বসন্ত-বন্দনা কি মিথ্যা?
আনিসুল হক: না। সত্যের চেয়েও অধিক সত্য। প্রথমে যে প্রশ্নটা করেছিলে, সেখানে আরেকটি প্রসঙ্গ ছিল, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনে হয়েছে, সেই দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন। জহির রায়হানের একটি উপন্যাস আছে ‘আরেক ফাল্গুন’। তো সবমিলিয়ে গণআন্দোলনের ইতিহাসও এই ফাল্গুনে যুক্ত আছে। যখন এরশাদ সাহেব সামরিক শাসন দিলেন তখন এটার প্রতিবাদে বের হলাম, সেটাও ছিল মধ্য ফেব্রুয়ারিতে; ১৪ বা ১৫ তারিখের দিকে। সেটা খুব বড় ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। ফলে ১৪ তারিখ যতটা না ভ্যালেন্টাইন, তার চেয়েও গণতন্ত্র আন্দোলন বড় মাইলস্টোন। কিন্তু জীবনে সবই তো চলবে। প্রেম-ভালোবাসা-কবিতা-আন্দোলন একসঙ্গে চলবে। আমরা তো আন্দোলন করি সুন্দর জীবন ও সুন্দর একটা পৃথিবীর জন্য। পৃথিবী হবে প্রেমময় ও হিংসাহীন।
- এই যে শীতের শেষে প্রকৃতি নতুন শরীর নেয়। এর সঙ্গে মানবজীবনের সাদৃশ্য কতটুকু রয়েছে বলে মনে করেন?
আনিসুল হক : এটা প্রকৃতির নিয়ম। মানুষের ক্ষেত্রে ওভাবে বলা যাবে না। তবে মানুষও একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। খুব সুন্দর একটি কবিতা আছে নির্মলেন্দু গুণের, ‘আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন আমি মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।’ আসলে আমরা বড় হই যতই, মৃত্যুর প্রয়োজনটা মেটানোর জন্য। প্রকৃতি আমাদের কিন্তু সংকেত দিতে থাকে। আমাদের চুল পেকে যায়, দাঁত পড়ে যায়, চামড়া শিথিল হচ্ছে। টি এস এলিয়টের কবিতার মধ্যে আছে, ‘আমরা ওল্ড হচ্ছি আর আমাদের প্যান্ট ফোল্ড করতে হচ্ছে।’ কারণ বয়স হলে আমরা দৈর্ঘ্যে বা উচ্চতায় একটু ছোটও হয়ে যাই। তখন প্যান্ট গুটিয়ে পরতে হয়। ফলে মানুষের ক্ষেত্রে প্রতিবছর আমরা প্রবীণ হচ্ছি এটাই বেশি মুখ্য। শিশুর হাসি সুন্দর। কবিরা লিখে এটা আরও সুন্দর করে যান। নারীর সৌন্দর্য সুন্দর, এটা কবিরা লিখে আরও সুন্দর করেছেন। নীরোদ সি চৌধুরী বলেছেন, বাংলার মানুষ আগে প্রেম করতে জানত না। তাদের শুধু ছিল কাম। প্রাচীন কাব্যগুলোতে শুধু কাম ছিল। রোমান্টিক প্রেম যেটা বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম উপন্যাসে লিখেন। ফলে বাঙালি রোমান্টিক প্রেম বলতে যা বোঝে, তা করতে শেখে। কাজেই বসন্ত নিয়ে যে বন্দনা করি এগুলো কবিদের বানানো।
- বসন্তে প্রেম এলে প্রকৃতির সান্নিধ্য নাকি প্রেমিকার সান্নিধ্য- কোনটা বেশি লোভনীয় মনে হয়?
আনিসুল হক : এটা প্রকৃতির দেওয়া প্রবণতাই যে, নারী পুরুষের কাছে যেতে চায়, পুরুষ নারীর কাছে যেতে চায়। কিন্তু এটা ম্যাচ করতে হবে। খুব সুন্দর পুরুষ দেখে আকৃষ্ট হতে পারে নারী। কারণ আমরা বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রথমে দেখি, কাছে গিয়ে যখন কথা বলতে শুরু করবে তখন দেখা গেল যে, ওই পুরুষটির কথা, মতÑ ওটা যাচ্ছে না। তখন আর ভালো লাগবে না। পরস্পরকে অ্যাপ্রিশিয়েট ও সম্মান করা শিখতে হবে। রূপে বা গুণে বা কথায় মুগ্ধ হয়ে একটা মেয়ে বা ছেলে কাছে আসতে পারে কিন্তু এসে যদি দেখে মানুষটি খুব অত্যাচারী লোক, ব্যবহার খারাপ, যুদ্ধের সমর্থক, তাহলে কিন্তু সঙ্গটা কেউ পছন্দ করবে না। আমাদের দেশে যেহেতু নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ নাই, প্রায় ক্ষেত্রে যেটা হয়, আমরা যাকে দেখি, তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। প্রেমে পড়ি। প্রেমটাকে অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করি। পরে ভুল মানুষকে পছন্দ করে সারাটা জীবন ভুগতে থাকি। আমরা প্রকৃতি থেকে আলাদা কিছু না। কিন্তু একজন স্বাভাবিক পুরুষের জন্য একটা স্বাভাবিক নারী বেশি লোভনীয়। তাদের সঙ্গটা বেশি উপভোগ্য।
- একটি কথা আছে এ রকম- প্রকৃত প্রেমিক হলেই ভালোবাসা পাওয়া যাবে না। ভালোবাসা পেতে হলে প্রকৃত অভিনেতাও হতে হবে। প্রেমের সঙ্গে কি ছলনার কোনো যোগ আছে?
আনিসুল হক : একদম না। বায়োলজিক্যালি প্রতিটি প্রজাতি তার বংশধর রেখে যেতে চায়। দৈহিক গঠনটাই এরকম। সেই জন্য যেটা হয় একটা পুরুষ ও একটা নারী তার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীটা নির্বাচন করতে চায়, যাতে সন্তান স্বাস্থ্যবান ও বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে এখানে ছলনার দরকার হয় না। আমি তরুণদের উপদেশ দিই, আপনি প্রথম দেখার দুই-তিন দিনের মধ্যেই কিন্তু বুঝতে পারার কথা, যাকে আপনার ভালো লেগেছে, তারও আপনাকে ভালো লাগছে কী না? শুধু একপাক্ষিক ভালো লাগলে প্রেমটা হবে না, উভয়ের ভালোলাগা এক হতে হবে। ভালোলাগার একটা স্তর আছে। আমরা সাধারণভাবে বিখ্যাত মানুষদের পেলে অ্যাপ্রিশিয়েট করি, সঙ্গ পছন্দ করি এবং বেশি মূল্য দিই। একজন তরুণী বিখ্যাত মানুষের পাশে এলে স্বাভাবিকভাবে তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে চাইবে, তাঁর পাশে দাঁড়াতে চাইবে। এর মানে এই নয় যে, প্রেম করতে চাইছে। আমাদের এগুলো বুঝতে হবে যে, কোনটা সাধারণ পছন্দ, কোনটা শ্রদ্ধা, কোনটা ভালোবাসা, কোনটা প্রেম, কোনটা কাম, কোনটা সঙ্গী নির্বাচন, কোনটা বিয়ের জন্য নির্বাচনÑ এগুলো আলাদা করতে হবে।
- জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন, স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর হাজার রাস্তা আছে। স্রষ্টা অথবা সৃষ্টির কাছে পৌঁছানোর জন্য জ্ঞান নাকি প্রেম; আপনি কোন রাস্তা বেছে নেবেন?
আনিসুল হক : আমি প্রেমের মানুষ। আমি শিল্পের পক্ষে। তত্ত্ব পছন্দ করি না। সৃষ্টিশীলতা আমার বেশি পছন্দের। ইতিহাস ও তত্ত্বের কথা বলে আমাকে কেউ জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি তা পছন্দ করি না। আমি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের খুব ভক্ত। ওনার একটা কথা হচ্ছে যে, আমি তাত্ত্বিকদের খুব অপছন্দ করি। কারণ তাত্ত্বিকেরা সবকিছুকে চারকোণা গর্তের মধ্যে গোল স্ক্রু ঢুকাতে চায়। তারা বলবে প্রেম এই, প্রেম জিনিসটা ওইরকম। আমার এটা জানার দরকার নেই। এটা স্বাভাবিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা। প্রেমটাকে যতটা পারি শিল্পিত করব, সংগীতময় করব। জ্ঞান নয়, প্রেমে বিশ্বাস করি। যদিও কবি বলেছেন, জ্ঞানের বিহনে প্রেম নাই। এটাও আবার সত্য কিন্তু। মূর্খের পক্ষে প্রেম করাটা কঠিন।
- প্রেম বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি জানতে চাই।
আনিসুল হক : আমার কথাটা হচ্ছে, নারী ও পুরুষের আকর্ষণটা প্রাকৃতিক। প্রেম প্রাকৃতিক নয়। এটা শৈল্পিক। এটা কবিদের সৃষ্টি। এটা শিল্পীদের সৃষ্টি। প্রেমকে তারা মহত্ত দান করেছেন। এই মহত্তের দরকার আছে। আমরা পুরো প্রাকৃতিক জীবনযাপন করি না। পোশাক আমাদের যেমন সভ্য করেছে, তেমন প্রেম জিনিসটাও। মানুষ প্রেমকে মহত্ত দান করেছে। ভালোবাসলে কিন্তু কাঁদতে হবে। ভালোবাসার সঙ্গে অশ্রুর সম্পর্ক আছে। যে চোখের জল ফেলেনি, সে কখনো ভালোবাসেনি।
- সম্প্রতি আপনার ছবির প্রদর্শনী শেষ হলো। ছবি আঁকার শুরুটা কবে থেকে?
আনিসুল হক : স্কুলে পড়াকালে ছবি আঁকার শুরু। আমার আঁকা দেয়ালপত্রিকা জাতীয় শিশু পুরস্কার পেয়েছে। ঢাকায় এসে আমরা তিনবার ফার্স্ট হই। হাতে আঁকতাম। হাতে লিখতাম। হাশেম স্যার, কবি আসাদ চৌধুরী বিচারক ছিলেন। সেই থেকে ছবি আঁকার অভ্যেস। মাঝখানে আঁকি নাই। কারণ বাংলাদেশের বড় আর্টিস্টদের আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। তো এই বড় বড় শিল্পীদের দেখে আমি ভেবেছি, আঁকার কাজটা বড় মানুষরাই করুক। তারপর একটা সময় লক্ষ করলাম, ছোটবেলায় যে রঙগুলো পাইনি, সেগুলো কেনার সামর্থ্য আমার হয়েছে। নিউমার্কেট থেকে রঙ কিনলাম এবং ছবি আঁকতে শুরু করলাম। আমাদের অফিসে তৌহিদা শিরোপা নামে একজন সহকর্মী ছিলেন। ভাবলাম, ওর জন্মদিনে কী উপহার দেব? ফেসবুক থেকে ওর একটি ছবি নিয়ে দু’এক টানে প্রতিকৃতি এঁকে ফেললাম। ওকে উপহার দিলাম। খুব খুশি হলো। কয়েকদিন পর কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের জন্মদিন ছিল। ওনার একটা প্রতিকৃতি এঁকে উপহার দিলাম। এভাবে মনে হতে থাকল, আরে! আমি তো পারি। এরপরে সৈয়দ শামসুল হকের ছবি আঁকলাম। ছবিটা এখন সবাই ব্যবহার করে। মনে হলো, এতো দিন লজ্জা পেয়েছি কেন? তখন আমি মনের দুঃখে পাগলের মতো ছবি আঁকতাম। ছবি আঁকলে মেডিটেশন হয়। প্রায় দুই শতাধিক ছবি এঁকেছিলাম। প্রদর্শনীতে নব্বইটা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।