Homeইন্টারভিউমানুষের শিশুসত্ত্বা হারায় না | ঝর্না রহমান

মানুষের শিশুসত্ত্বা হারায় না | ঝর্না রহমান

স্কুলজীবন থেকেই ঝর্না রহমানের লেখালেখি শুরু। গল্প, কবিতা, গান, ছড়া—শিশুসাহিত্যের সব শাখায় তাঁর বিচরণ। তাঁর লেখনী আজও সমান সচল। দেশাত্মবোধ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবনের প্রতি মুগ্ধতা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। তিনি অর্জন করেছেন একুশে সাহিত্য পুরস্কার, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ঝর্না রহমানের শৈশব এবং শিশুসাহিত্য এই সাক্ষাৎকারের উপজীব্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি।

  • স্বরলিপি : একালের দাদির গল্প বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাই।

ঝর্না রহমান : অতীতের দাদি-নানিদের মুখে বলা গল্পগাথা বা কিচ্ছাকাহিনির দিন এখন আর নেই। রাক্ষসখোক্কস, দৈত্যদানো, ব্যঙ্গমাব্যঙ্গমি, ‘এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বা ‘বুড়ো আংলা’Ñ এদের গল্প বলে এখন আর শিশুদের আনন্দ দেওয়া যায় না। প্রযুক্তির যুগে বিশ্ব এখন শিশুদেরও হাতের মুঠোয় এসে গেছে। ওরা এখন বিজ্ঞান জানে। গুগল সার্চ দিয়ে লেখাপড়া করে। এখন নারীও আর আগের মতো নিরক্ষর বা অন্ধকারে নেই। শিক্ষিত নারীরা যখন দাদি-নানি হচ্ছেন, তখন তারা নাতি-নাতনির সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন বইটিতে আমি সে কথা বলার চেষ্টা করেছি।

একজন শিক্ষিতা বয়স্ক নারী, তিনি নাতি-নাতনিদের সঙ্গে গল্পের আসর বসিয়েছেন। তিনি তাদের মনে এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ ইত্যাদির প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলার জন্য গল্প করছেন। এখানে গল্পগুলোর আঙ্গিকে বিশেষত্ব আছে।

আনন্দের ভেতর দিয়ে, ভালোলাগার ভেতর দিয়ে গল্প এগিয়ে চলছে। সেই সঙ্গে দাদির শৈশবের গল্পও এখানে উঠে এসেছে। এভাবে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে এই সময়ের একটা মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা গল্পগুলোতে আছে।

  • স্বরলিপি : আপনার লেখা হুলো বিড়াল টুলো বিড়াল বইটির নামের মধ্যেই ছন্দ রয়েছে। শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনায় কোন দিকটাকে বেশি প্রাধান্য দেন?

ঝর্না রহমান : বইয়ের নামকরণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য বইয়ের নাম এমনভাবে দেওয়া দরকার, যাতে ভেতরের গল্পের প্রতি ওদের আগ্রহ জন্মে।

শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনায় আমি শিশুমনের বিকাশের জন্য, আনন্দের সঙ্গে জীবনের ইতিবাচক বিষয়ের শিক্ষাগ্রহণটাকে প্রাধান্য দেই। যত দিন যাচ্ছে, তত আমাদের সমাজ এবং বিশ্বে সন্ত্রাস, হানাহানি, যুদ্ধ, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা বেড়ে যাচ্ছে। কাজ না-করে টাকা উপার্জনের চিন্তা, বই না-পড়ে ভালো রেজাল্ট করার চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। আমার কাজ গল্পের ভেতর দিয়ে শিশুমনে উন্নত বোধ জাগিয়ে তোলা। কিন্তু গল্পের মূল বিষয় থাকবে আনন্দ। গল্প পড়তে গিয়ে যাতে মনে না হয় তাকে ক্লাসের পড়া পড়তে হচ্ছে, পরীক্ষা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, শিশুরা শিক্ষালাভ করবে আনন্দের সঙ্গে। শিশুসাহিত্যে আমি শিশুর মনোবিকাশ আর আনন্দপাঠÑ এই দুটোর মেলবন্ধন ঘটাতে চাই।

  • স্বরলিপি : দাঁত পরীর উপহার কিংবা নীরজনা ও নীল আমগাছ বইয়ে মা আর মেয়েÑ নিজের জীবনের কি কোনো প্রতিচ্ছায়া? বা সমাজে কাছের কোনো মানুষ?

ঝর্না রহমান : সাহিত্য তো জীবনেরই কথকতা। আমাদের চারপাশে যে জীবন প্রবাহিত হয়, সাহিত্যিক সেখান থেকেই তার লেখার রসদ সংগ্রহ করেন। ‘দাঁত পরীর উপহার’ বা ‘নীরজনা ও নীল আমগাছ’ গল্পে দুজন মেয়েশিশু আর তাদের মায়ের সঙ্গে মধুর সম্পর্কের কথা আছে। একজন সচেতন মা কেমন করে তার মেয়েকে ট্রুথ ফেইরির কল্পিত উপহারের মিথ থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনেন, কেমন করে সেখানে গল্পও থাকে, আনন্দও থাকে, আবার বাস্তবজ্ঞানও থাকে, সেটাই আছে এখানে। ওদিকে নীরজনার মা কর্মজীবী নারী। তিনি মেয়েকে স্কুলের জন্য তৈরি করে দেন। স্কুলে নামিয়ে দেন। শিশুটি কিন্তু বুঝে নেয়, মায়েরও কাজ আছে। এসব চিত্র তো আমাদের চারপাশেই আছে। আমি নিজেও কর্মজীবী নারী। সংসার করে, বাচ্চাদের লালন-পালন করে কলেজে গিয়েছি। ওরাও স্কুলে গেছে। কত গল্প প্রতিদিন সৃষ্টি হয়েছে তার কি হিসাব আছে!

  • স্বরলিপি : পরমা হারিয়ে গিয়েছিলÑ পরমা চরিত্রটির মাধ্যমে শিশুদের সতর্ক করা হয়েছে। সাহিত্যের মাধ্যমে শিশুদের সচেতনতা বোধ তৈরি করা যায় বলে কি মনে করেন?

ঝর্না রহমান : হ্যাঁ। ‘পরমা হারিয়ে গিয়েছিল’ একটি সচেতনতামূলক গল্প। কোনো শিশু-কিশোর কোথাও হারিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভয় না পেয়ে কী কী বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজের ঠিকানায় ফিরে আসতে পারে, এটি তেমনই একটা গল্প।

সাহিত্যের মাধ্যমে শিশুদের সচেতনতা তৈরি করা যায়। মানবিকতা, উদারতা, গাছপালা-পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা, পরিবেশ সচেতনতা, আপন ভাষা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসাÑ সব বিষয়েই সচেতন করে তোলা যায়।

  • স্বরলিপি : কখন থেকে শিশুসাহিত্য রচনা শুরু করলেন?

ঝর্না রহমান : বলতে গেলে ছোটবেলা থেকে। স্কুলজীবনেই আমি অনেক ছড়া, গল্প, কাব্যকাহিনি লিখতাম। কলেজে উঠে নিজে ছবি এঁকে, রঙ করে ছড়া লিখে নিজেই বই বানিয়েছি। তবে পত্রপত্রিকায় শিশু-কিশোর গল্প, কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে আশির দশক থেকে।

  • স্বরলিপি : ছোটবেলার সঙ্গে জীবনের এ বেলায় চারপাশের পরিবেশ কেমন দেখেছেন?

ঝর্না রহমান : ছেলেবেলায় আমি গ্রাম ও শহর দু’জায়গায়ই থেকেছি। তখন গ্রাম ছিল উদার প্রকৃতিতে সাজানো। কোলাহল নেই। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ছিল। যৌথ আনন্দ ছিল। অল্পে তুষ্ট ছিল মানুষ। জমকালো জীবন ছিল না। অপচয় ছিল না। শহুরে জীবনও ছিল শান্ত। অনেক ফাঁকা শহর। রাস্তার দু’পাশে গাছপালা। মহল্লার মানুষ সবাই সবাইকে চিনত। এমন উঁচু ভবন, ফ্লাইওভার কিচ্ছু ছিল না। আমরা রিকশা আর বাসে দূরে যেতাম। স্কুলে যেতাম দলবেঁধে হেঁটে। স্কুলব্যাগও ছিল না। বুকে বই চেপে আঙুলের ফাঁকে কলম বা পেন্সিল আটকে স্কুলে যেতাম। খুব সরল নিরাভরণ সুন্দর পরিবেশ ছিল।

  • স্বরলিপি : মানুষ বড় হলে কি শিশুসত্ত্বা হারিয়ে যায়?

ঝর্না রহমান : মানুষ বড় হলেও শিশুসত্ত্বা হারায় না। গোলাম মোস্তফার কবিতাকে উল্টিয়ে বলা যায়, ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট শিশু সকল পিতার অন্তরে…

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular