সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সাহিত্য বা পপুলার লিটারেচার ধারণাটি সম্প্রতি বেশ মনোযোগ পাচ্ছে। বিষয়টি শুধু একাডেমিক ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পাচ্ছে এমন নয়। বরং সৃজনশীল সাহিত্য রচনার সঙ্গে যারা যুক্ত তারাও পাঠকের প্রতিক্রিয়া এবং কার্যক্রমের বিষয়গুলোকে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করতে চাচ্ছেন। ফলে জনপ্রিয় সাহিত্যের ব্যবহারিক দিকও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। পপুলার কালচার অধ্যয়নের ক্ষেত্র অনেক বড়। বিশেষত যেসব সাহিত্য ক্যানন বা ধ্রুপদী মর্যাদা পায় তাদের পাশে দীর্ঘদিন জনপ্রিয় সাহিত্যকে সাহিত্যিক মানের হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হলেও এখন সেখানে পরিবর্তন এসেছে। জনপ্রিয় সাহিত্যের গুরুত্ব বোঝার সময় বর্তমান সময়ের বিষয়বস্তু, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও মনস্তত্বগত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসন্ধান করতে হয়। তাই কাজটি বেশ জটিল। জনপ্রিয় সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে একাডেমিয়া অনেক সময় এমন সমালোচনা পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন যার ফলে বিষয়টি সাধারন পাঠক কিংবা লেখকদের জন্যও জটিল হয়ে উঠেছে। কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্যকে সমালোচনার স্বার্থেই কলাবিদ্যার পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
যখনই আমরা পপুলার কালচার বলছি তখন মূলত গোটা সংস্কৃতির অনুভূতি এখানে যুক্ত থাকে। এমন নয় যে বিশুদ্ধ বা পরিশীলিত সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা সংস্কৃতির সামগ্রিকতা ধারণ করে না। কিন্তু এ দুটো ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো, জনপ্রিয় সাহিত্যকে একটি পণ্য হিসেবেই ভাবা হয়। জনপ্রিয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাহিত্য সমালোচনার প্রচলিত শৈলীবিজ্ঞান প্রয়োগ করা হয় না। একসময় সাহিত্যবিশারদরা ডাইম নভেল, গোয়েন্দা গল্পসহ অন্যান্য জনরার লেখাকে উপসাহিত্য (সাব-লিটারেচার) বলে অভিহিত করতেন। এভাবে গণকৃষ্টির সঙ্গে অভিজাত সংস্কৃতির পার্থক্য পরিমাপ করা সম্ভব হতো। কিন্তু প্রতিটি সাহিত্যরূপেরই সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকে। কিন্তু এ ধরনের বিভাজন থাকায় আমরা জনপ্রিয় সাহিত্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের মানসিকতাও অনেকের মধ্যে কাজ করে না। উপসাহিত্য ধারণাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠকদের বিভ্রান্তিতে ফেলতো। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পপুলার কালচার অধ্যয়ন শুরু হয় তখন দেখা গেলো, জনপ্রিয় সাহিত্য শুধু একটি পণ্য নয়। এর সাংস্কৃতিক গুরুত্বও রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় সাহিত্য মিথকে অবলম্বন করতে শুরু করেছে। কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্যে মিথের ব্যবহার করার সময় আমরা প্লটের সঙ্গে পুরাণের সময়ের ফারাকটা ধরতে পারি না। পুরাণ জনপ্রিয় সাহিত্যে এক ধরনের ধারাবাহিকতা তৈরি করে। কারণ পুরাণের সঙ্গে প্রাচীনকালের সাহিত্যগুলো গুচ্ছ আকারে সংযুক্ত থাকে। এ বিষয়ে গ্রেকো রোমান স্কলার জর্জ সন্ডার্সের বক্তব্য: থ্রিলার বলেই জেমস বন্ড মানুষের কাছে জনপ্রিয় এমনটি ভাবলে হবে না। বরং জেমস বন্ডের গল্পটি মহাকাব্য ও রোমান্সের কাঠামো অনুসরণ করে। কিংবদন্তী ও পুরাণের আধুনিক ব্যবহার করতে পারে বলেই সমাজের মানুষ এ ধরনের সাহিত্য পাঠে বেশি আগ্রহী থাকে।
যেকোনো কলার ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতিনীতি আর নতুন উদ্ভাবনের সম্মিলন থাকে। হোমার ও শেক্সপীয়রের রচনাতেও আমরা তা পাই। তারা প্রচলিত রীতিনীতিগুলোকে নিয়ে নিজস্ব উদ্ভাবনের মাধ্যমে সাজাতে পেরেছিলেন বলেই তাদের মহান সাহিত্যিক বলা হয়। যেমন শেক্সপিয়রের হেমলেট প্রতিশোধের ধ্রুপদী গল্পের কাঠামো মেনে লেখা হলেও একমাত্র শেক্সপিয়রই প্রতিটি চরিত্রের দৃষ্টিকোণে জগতের বাস্তবতার ভিন্নতা তৈরি করতে পেরেছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সংস্কৃতি অনেকটা থিতু ছিল বলে জনপ্রিয় কিংবা অভিজাত—এসব পার্থক্য আমাদের বিবেচনা করতে হতো না। রেঁনেসার পর সংস্কৃতি বহুমাত্রিকতা পেতে শুরু করে এবং একই সময়ে সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের অধারাবাহিকতা দেখা যায়। ফলে এর প্রভাব পড়ে সাহিত্যে।
আধুনিক যুগে সাধারন মানুষের যোগাযোগের পদ্ধতির বৈচিত্র্য বেড়েছ্যে। ফলে বৃহৎ পরিসরে সাহিত্য পৌছুতে পারে। কিন্তু অভিজাত বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই দ্রুত সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা প্রণয়নের বিষয়টিকে জোর দেয়। এজন্যই আমরা জেমস জয়েসের ফিনেগানস ওয়েক-এর মত উপন্যাস পেয়েছি। তাই জনপ্রিয় সাহিত্যের সঙ্গে মূলধারার সাহিত্যের পার্থক্য যাচাই করা যায় প্রচলিত রীতিনীতি ও লেখকের নিজস্ব উদ্ভাবনের তুলনামূলক বিবেচনার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে জেমস জয়েস অবশ্যই সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এখানে আমরা দুটো মেরু ভাবতে পারি। একটিতে প্রচলিত রীতি ধরেই লেখা আর অন্যটিতে উদ্ভাবন আনা। লোন রেঞ্জার কিংবা টারজানকে নিয়ে লেখা গল্পগুলোকে প্রথম মেরুতে রাখতে হয়। অন্যদিকে জেমস জয়েসকে দ্বিতীয় মেরুতে। এমনকি টি এস এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড কিংবা স্যামুয়েল ব্যাকেটের ওয়েইটিং ফর গডোট নাটকটিকেও দ্বিতীয় মেরুতে রাখতে হয়। কারণ প্রচলিত শব্দ বা থিমকেই লেখকরা এমন অভিনব শৈলিতে উপস্থাপন করেন যে পাঠক চমকে ওঠে। পরিচিত কাঠামোটিই পাঠককে চমকে দেয়। এজন্যই সিরিয়াস সাহিত্য নিয়ে সাহিত্য সমালোচকরা উচ্ছ্বসিত থাকতে পারেন।
জনপ্রিয় সাহিত্য ধারণাটির ক্ষেত্রে নন্দনতাত্বিক দিকটিকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। মূলত সাহিত্যে জনরা বিভাজনের ক্ষেত্রেই আমরা এক ধরনের বিভ্রান্তিতে পড়ি। জনপ্রিয় সাহিত্যকে আদৌ কোনো জনরায় ফেলা যায়? এক্ষেত্রে নর্থপ ফ্রায়ারের ধারণাটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মেনে নেয়া যায়। তার মতে, যেকোনো সাহিত্যের জনরা মূলত ওই বইয়ে জীবনের চক্র যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। তাই আধুনিক সময়ে কমেডি, হরর, মিস্ট্রি, রোমান্স থেকে শুরু করে আরও জনরা তৈরি হচ্ছে। জনপ্রিয় সাহিত্য এক্ষেত্রে যে মূলধারার সংস্কৃতির বাইরে এমন বলা যাবে না। যেমন ওয়েস্টার্ন এবং স্পাই থ্রিলারগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন নায়কের অভিযাত্রার ধ্রুপদী কাঠামোই অনুসরণ করা হয়। এ ধরনের ইডিপাল মিথগুলো যখন আধুনিক সময়ে চটকদারভাবে উপস্থাপন করা হয় তখন পাঠকরা তা লুফে নেয়।
অর্থাৎ ধ্রুপদী সাহিত্যের গল্প বা সাহিত্যের গতির কাঠামো অনুসরণ করেই জনপ্রিয় সাহিত্য লেখা হয়। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পার্থক্য গড়ে তোলাই প্রধান উদ্দেশ্য থাকে। যেমন ওয়েস্টার্ন উপন্যাস আমাদের উনিশ শতকের আমেরিকার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করায় অন্যদিকে স্পাই থ্রিলার বিশ শতকের ইংল্যান্ডের সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই লেখা। কিন্তু সময় বদলাতে শুরু করলে জনপ্রিয় সাহিত্যের রুচিও বদলাতে শুরু করে। যেমন ১৯৫০ সালের দিকে ওয়েস্টার্ন উপন্যাসে বন্দুকযুদ্ধের বর্ণনা যেমন ছিল, হাল আমলের ওয়েন উইস্টার কিংবা জেন গ্রের কাউবয় রোমান্সের বর্ণনাভঙ্গি তেমন থাকেনি। অর্থাৎ জনপ্রিয় সাহিত্য মূলত প্রচলিত সাহিত্য কাঠামোকেই অবলম্বন করে রচিত হয়। এজন্য জনপ্রিয় সাহিত্যে সচরাচর সীমিত চরিত্র, প্লট এবং গল্পের কাঠামো থাকে। কিন্তু মূলধারার সাহিত্যে এমন সীমাবদ্ধতা থাকে না। যেমন ইডিপাস মিথকে আমরা ইডিপাস রেক্স থেকে শুরু করে আধুনিক ওয়েস্টার্ন উপন্যাসের সমালোচনায়ও ব্যবহার করতে পারি। সাহিত্য সমালোচনার জন্য পুরাণকে ব্যবহার করা একটু কঠিন অবশ্যই। কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্যে পুরাণ অনেকাংশে জীবিত থাকে। অন্যদিকে আমরা যদি জনপ্রিয় সাহিত্যকে দেখি তাহলে দেখবো ওয়েস্টার্ন উপন্যাসগুলোর প্রেক্ষাপট, সূচনা পরিবেশ এমনকি ক্লাইম্যাক্স অ্যাকশনও অনেকটা একই ধাঁচের হয়ে থাকে। মিথ দিয়ে যাচাই করলে বোঝা যায়, ওয়েস্টার্ন উপন্যাসগুলোর মধ্যে দুয়েকটা জায়গা বাদে গল্পের কাঠামোয় বড় কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ জনপ্রিয় সাহিত্যকে কাঠামো অনুসরণ করতে হয়। ওয়েস্টার্ন উপন্যাসগুলো কোনো নির্ধারিত সময়, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন কিংবা সীমান্তের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়। আবার রহস্য গল্পে যদি একটি যুক্তিসম্পন্ন সমাধান না আসে তাহলে সেটিকে ব্যর্থ বলে পাঠকরা এড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় সাহিত্য মানুষের রসবোধের বদলে প্রচলিত সাংস্কৃতিক প্রথাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারণাটিকে আরও স্পষ্ট করার জন্য আমরা ক্রীড়াক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। বিশ্বে খেলাধূলা একটি বড় আর্থিক খাত। এখানে দর্শকরা খেলার অংশ হতে পারে বলে তারা এর জন্য নিবেদিত থাকে। সাংস্কৃতিক পণ্য হিসেবে জনপ্রিয় সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ওয়েস্টার্ন উপন্যাস এক্ষেত্রে পাঠককে কোনো খেলা দেখার উত্তেজনার সামিল করতে পারে। এক্ষেত্রে ওয়েস্টার্ন উপন্যাস তিনটি ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রথমত তারা প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করে, নানা ধরনের সাস্পেন্স দিয়ে পাঠককে সচকিত রাখে এবং অবশেষে একটি সুখপাঠ্য পরিণতি টানে। এ ধরনের কাঠামোয় দেখা যায়, একটি শহরের মানুষ সুখী থাকতে পারছে না কারণ আইনের শাসন নেই। তখন একজন নায়কের আবির্ভাব হয় এবং সে একটি সমাধান এনে দেয়। এই সমাধানের পথে তার কার্যক্রমের বৈচিত্র্য কতটা নতুনভাবে লেখক তুলে আনবেন তার ওপর নির্ভর করে জনপ্রিয় সাহিত্যের সফলতা। এখানে পাঠক মূলত খেলার মতোই একটি বিজয়ী পক্ষ দেখতে চায়—নায়ক গল্পের খলনায়ককে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করবে; এমন প্রত্যাশা বাড়ায়।
তাই জনপ্রিয় সাহিত্য এক ধরনের ফর্মুলা সাহিত্য। আর ফর্মুলা সাহিত্যে প্রতিটি চরিত্র ওই সময়ের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠ্য ধারণ করে রাখে। তবে পাঠক যেহেতু সচেতন হয়ে উঠছে তাই ফর্মুলা গল্পগুলো আগের মত পাঠককে টেনে ধরতে পারে না। জনপ্রিয় সাহিত্যের একটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যও রয়েছে। যেমন আমরা বিব্লিক্যাল এপিক, সিডাকশন উপন্যাস এবং গোয়েন্দা গল্পে দেখি। এগুলো একটি ফরমুলা অনুসরণ করে চলে। তাই জনপ্রিয় সাহিত্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক রয়েছে। আধুনিক সময়ে পপুলার কালচার এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে নির্দিষ্ট ফরমুলাগুলো বুঝতে পারলে জনপ্রিয় সাহিত্যকেও সাহিত্য অধ্যয়নে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশেষত জনপ্রিয় সাহিত্য জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে অনুসন্ধানে সহায়তা করতে পারে। তাই জনপ্রিয় সাহিত্যের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
এ প্রবন্ধটি অক্সফোর্ড: ব্ল্যাকওয়েল পাবলিশিং প্রকাশিত ‘পপুলার কালচার: প্রোডাকশন অ্যান্ড কনসাম্পশন’ থেকে অনুদিত। ভাষান্তর করেছেন: আবেদিন আকাশ