Homeইন্টারভিউবাংলা ভাষার উন্নয়ন গবেষণা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি । যতীন...

বাংলা ভাষার উন্নয়ন গবেষণা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি । যতীন সরকার

ভাষাসৈনিক যতীন সরকার, বাংলাদেশের একজন প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ গভীর মননশীলতা ও মুক্তচিন্তার স্বাক্ষর বহন করে। তিনি সর্বদা মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক নিপীড়ন, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিহত করার জন্য কথা বলেছেন। অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। যতীন সরকার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ : পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, মুক্তবুদ্ধির চড়াই-উতরাই প্রভৃতি। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। সাড়ে ৩ দিনের পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এহসান হায়দার

  • পুরো একটি মাস বরাদ্দ ভাষার জন্যে হাহাকার! ভাষার মাসে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা নেই বলে কত কান্নাকাটি করি। ২১ ফেব্রুয়ারি লক্ষ লক্ষ লোক শহিদ মিনারে যাই; লক্ষ গজ কালো কাপড়, গাদা গাদা গাঁদাফুল, হাজার হাজার ব্যানার-ফেস্টুন, তবু মন ভরে না। এরপর বাংলা ভাষা রক্ষার নিমিত্তে চর্চা কতটা কমে যায় আমরা জানি। এর সমাধান কী?

যতীন সরকার : বাংলা ভাষাকে যে মর্যাদা দেওয়া উচিত তা আমরা দিচ্ছি না। ইংরেজিকে অনেক সময় বেশি প্রাধান্য দেই এবং ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো অনেক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মাঝে একটি অর্থনৈতিক ব্যাপারও রয়েছে। সারা পৃথিবীতে আমরা এখন বিচরণ করছি, ইউরোপে গিয়ে অনেক কথা স্মরণ করি, সেজন্য অবশ্যই ইংরেজি ভাষা জানতে হবে। এটা কোনো দোষের বিষয় নয়। দোষের বিষয় হচ্ছেÑআমরা শুধু ইংরেজি পড়ব, ইংরেজিতে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করব; এ ধরনের কথা যেখানে এসে যায়, তখন নিন্দা না করে পারা যায় না। ইংরেজি ভাষার শব্দভান্ডার থেকে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি, বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছি এর মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষাকে ইংরেজির সাথে তুলনা করা চলে। বাংলা গদ্য লেখার মধ্যে কমা, দাড়ি, সেমিকোলন আমরা ইংরেজি ভাষা থেকেই পেয়েছি। কাজেই ছেলেমেয়েরা এই ভাষা শিখবে, আমরা ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে একটা গোষ্ঠী এমন তৈরি হয়েছে, যাদের ইংরেজির সাথে আত্মীয়তার বন্ধন। ইংরেজি শিখলেই সব কাজ হয়ে যায়, বাংলার দরকার পড়ছে না। ইংরেজি বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজিতে পড়ছে, তারা কেউ ভালো করে বাংলা জানে না এবং তা গর্বের সাথে স্বীকার করেন। এই অবস্থার জন্য আমাদের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী।

  • ভাষার জন্য আমাদের স্তুতি আছে, প্রস্তুতি নাইÑএভাবে ভাবনা এসে যায় মাঝে মাঝে। আপনি কী বলবেন এই ক্ষেত্রে?

যতীন সরকার : প্রস্তুতি যেমন নাই, তেমন প্রস্তুতির ইচ্ছেশক্তিও থাকতে হবে। তখনকার সময়েÑ১৯৬১ সন থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা যাবে নাÑএ ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। এগুলো মনে রাখতে হবে। আমি একটা কথা বলি বারবার, বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে হবে, বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যে কাজ করতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এই বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য কোনো চেষ্টাই করা হয়নি।

  • আপনি যখন ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হলেন, তখনকার সময় সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন।

যতীন সরকার : ১৯৫২ সনে আমি গ্রামের স্কুলে পড়তাম। সে স্কুলে হঠাৎ একদিন খবর পেলাম, ২১ ফেব্রুয়ারি যারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল, তাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছে। বসুর বাজার বলে গ্রামে একটা বাজার আছে, আমি কেন্দুয়া এলাকার আসুজী হাই স্কুলে পড়তাম। বাজারে যারা আসতেন তাদেরকে ২১ ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য জানিয়েছিলাম এবং ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করেছিলাম। আমার এই কথাগুলো বেশিরভাগ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন। যারা গ্রহণ করেননি, তারা নানারকম কথা বলতে লাগলেন। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যারা ছিলেন তারা বললেন, ভোট দান করার ব্যবস্থা করবেন। ভাষা আন্দোলনের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি আমার সাধ্যমতো কাজ করেছি। আমাদের ভাষা নিয়ে যে সমস্ত বইপত্র প্রকাশিত হয়, তাতে বড় শহর, বড় থানা ছাড়া মফস্বলের কথা উল্লেখ থাকে না। যদি মফস্বলের মানুষকে, অজপাড়াগাঁয়ের মানুষকে জাগ্রত করা না যেত, তাহলে ভাষা আন্দোলনে কোনোভাবেই সাফল্য লাভ করতে পারতাম না এবং দেশ সৃষ্টির প্রয়াসে অগ্রগামী হতে পারতাম না।

  • একটি রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এমন ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সাত দশকে বাংলা ভাষার অর্জন নিয়ে কী বলা যায়?

যতীন সরকার : একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। আন্দোলনের একটা পর্যায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’Ñএই ধরনের গান রচিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন কী পটভূমি নিয়ে এলো এই বিষয়টা আমাদের জানা দরকার। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের যে চিন্তা-চেতনা এবং ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনেই এক সময় ভাষার একাত্মতায় আমাদের দেশকে ভালো করে বুঝে ওঠার একটা প্রয়াস দেখা যায়। বলতে গেলে পাকিস্তানি অপরাষ্ট্রের অধিবাসী যখন হয়েছিলাম, তার সঙ্গে আমরা মোহমুক্ত হবার পেপার পেয়ে গেছি। তথাকথিত পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা তারাই এটা করে দিয়েছেন। যেমন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৪৮ সনে বলেছিলেনÑউর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এ কথা আমাদের আঘাত করে, আমাদের জাগ্রত করে তোলে। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে আমাদের বাঙালি সমাজের সবকিছুতে বিব্রতকর অবস্থা হতো। এতে করে আমাদের কোনো প্রাপ্তি হতো না, বরং অনেক অপ্রাপ্তি দেখা দিতো। উর্দুতে কথা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হোক এটা আমরা চেয়েছিলাম। এর অর্জন আজকের বাংলাদেশ, এই বাঙালির মায়ের ভাষা বাংলা। 

বাংলা ভাষার উন্নয়ন-গবেষণা নিয়ে আমাদের ভাবনা কোথায়?

যতীন সরকার : বাংলা ভাষার উন্নয়ন-গবেষণা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। এটা আমাদের চিন্তার স্থূলতা এবং ব্যর্থতা। ইংরেজি ভাষা জেনে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে অবজ্ঞা করে গর্বিত হবার কিছু নেই।

  • ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ সনÑকথাটা বলি না, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল বলে থাকি; আবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে খোশ মেজাজে থাকি, শহিদ দিবস বলি না। ভাষার কি উন্নতি হলো এতে?

যতীন সরকার : বিশ্বে এখন বাংলা ভাষা যেভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে, ৮ ফাল্গুন হলে দেশের বাইরের মানুষের কাছে এত সহজে গ্রহণযোগ্যতা পেত না। ২১ ফেব্রুয়ারি বলেই গানে, কবিতায় এটি খুব সহজে স্থান করে নিচ্ছে। বাইরের দেশের মানুষ এর গভীরতা বুঝতে পারছে, আর ভাষার জন্য আমাদের এই আন্দোলনের কথা মানুষ অনুভব করতে পারছে।

  • বাংলা ভাষা চর্চা হোক সর্বত্রÑএই প্রচেষ্টা ছিল আপনাদের সর্বদা, কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি আজও। বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানাবেন?

যতীন সরকার : আমাদের বাংলা ভাষা কেন সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নাÑএ বিষয়টি নিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে হবে। হ্যাঁ, আমরা বাংলা ভাষার পক্ষে যারা ছিলাম, যারা চেয়েছিলাম বাংলা রাষ্ট্রভাষা হোকÑআমরা কিন্তু অন্য ভাষার প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতাম না। আমরা চেয়েছিলাম বাংলা হোক পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। পশ্চিম পাকিস্তানে অন্য যে সকল ভাষা রয়েছে সে অনুযায়ী সেই ভাষাগুলোরও প্রচলন থাকবে, কিন্তু কোনোমতেই বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত বা বিকৃত করার চিন্তা করা যাবে না। আমাদের বাংলা ভাষা যেভাবে চলা উচিৎ আমরা সেইভাবে চলছি না। বাংলা ভাষার পরিবর্তে আমরা অনেক সময় ইংরেজির আশ্রয় নিই। ইংরেজি মাধ্যমের অনেক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই বিষয়টিকে যদি দেখা যায়, তবে দেখব যে এর মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যাপার আছে। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সকল দেশ, আমরাও যদি সেদিকে এগিয়ে যেতে চাই তবে ইংরেজি জানাটাও জরুরি। এটা খুব দোষের ব্যাপার নয়। কিন্তু দোষের ব্যাপার সেখানেইÑআমরা ইংরেজিতে লেখাপড়া করব, ইংরেজিতেই আমরা আমাদের ভাবনা প্রকাশ করব; এই বিষয়গুলো যখন চলে আসে, তখন এর নিন্দা না করে পারা যায় না। ইংরেজি শিখবে আমাদের ছেলেমেয়েরা, এর বিরুদ্ধে আমরা নই; কিন্তু যখন দেখা যায়Ñএকটা গোষ্ঠী এমন হয়ে গেছে, তারা মনে করে ইংরেজি আমাদের আত্মিকতার বন্ধন তৈরি করে দেয়, ইংরেজি শিখলেই আমাদের সব কাজ হয়ে যায়, বাংলা ভাষার কোনো দরকার পড়ে না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে বলে বাংলাটা জানে না তার সন্তানÑঅনেক অভিভাবক এই কথা গর্বের সঙ্গে বলেন। এই যে ব্যাপারগুলো সংঘটিত হচ্ছে, এর জন্য আমরা নিজেরা দায়ী। ফলে আমার মনে হয়, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য রক্ষা করে বাংলা ভাষার পক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। তা না হলে আরও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।     

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular