‘টু প্রোভাইড বেস্ট কোয়ালিটি কনটেন্ট উইথ কস্ট ইফেকটিভ ওয়ে’Ñএই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল ‘কিন্ডারবুকস’ ও ‘বেঙ্গলবুকস’-এর যাত্রা। এই যাত্রার কান্ডারি মাহমুদুল হাসান, যিনি প্রতিষ্ঠান দু’টির প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। লন্ডনের কভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ সম্পন্ন করে দেশে ফিরে হাল ধরেন একটি বৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। সাড়ে ৩ দিনের পত্রিকার পক্ষ থেকে অত্যন্ত সফল এই তরুণ প্রকাশকের মুখোমুখি হয়েছিলেন তৌহিদ ইমাম
অমর একুশে বইমেলায় আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গলবুকস’ ও ‘কিন্ডারবুকস’ বরাবরের মতোই সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ করছে। গতবছর আপনারা একটি সম্মানজনক সম্মাননাতেও ভূষিত হয়েছিলেন। অতি অল্প সময়ে লেখক-পাঠকদের কাছে আপনাদের গ্রহণযোগ্যতা রীতিমত ঈর্ষণীয়। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রশ্নটা করছি, আপনারা কি বই করেন বছরজুড়ে? নাকি কেবল বইমেলাকে কেন্দ্র করে?
মাহমুদুল হাসান : অমর একুশে বইমেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের এক অনন্য অংশ। প্রকাশকদের জন্য এটি শুধু বই বিক্রির জায়গা নয়, বরং পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের বড় সুযোগ। নতুন গ্রন্থ প্রকাশের জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ এই মেলার মাধ্যমে নতুন লেখকদের বই পাঠকদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়। বেঙ্গলবুকস ও কিন্ডারবুকস সবসময় চেষ্টা করে নতুন ও মানসম্মত বই প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকদের একটি সমৃদ্ধ পাঠ-অভিজ্ঞতা দিতে। কিন্তু এটা শুধু একমাসের বইমেলাকে কেন্দ্র করে হওয়া উচিত নয়। আমাদের জার্নি জারি থাকে বছরজুড়েই। যখনই আমাদের হাতে ভালো কোনো পাণ্ডুলিপি আসে, আমরা চেষ্টা করি সন্তোষজনক সম্পাদনার মাধ্যমে, সুদৃশ্য প্রচ্ছদ, টেকসই বাঁধাইÑসর্বোপরি মানসম্পন্ন প্রোডাকশনের মাধ্যমে বইটা বাজারে আনতে। সেটা বছরের যেকোনো সময়ই হতে পারে।
বইমেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহমুদুল হাসান : কেবল বইমেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশ করেন মূলত মৌসুমী প্রকাশকরা। কিন্তু যাঁরা পেশাদার প্রকাশক, তাঁরা চেষ্টা করেন সারাবছরই বই করতে। যদিও বইমেলা বই বিক্রির সবচেয়ে বড় আয়োজন। তাই নির্বাচিত কিছু বই বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশিত হতে পারে। তবে সারাবছরই মানসম্মত বই বের হওয়া দরকার, শুধু বইমেলায় নয়।
আমাদের সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল বইপাঠের প্রচলন অত্যন্ত কম; সেই অবস্থা থেকে আপনি প্রথমে কিন্ডারবুকস, পরে বেঙ্গলবুকস-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে নতুনভাবে যুক্ত করেছেন এদেশের প্রকাশনা জগতে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন?
মাহমুদুল হাসান : আমরা দেখেছি যে দেশে পাঠ্যবইয়ের বাইরে সৃজনশীল বই পাঠের অভ্যাস তুলনামূলকভাবে কম। এ কারণে আমরা শিশুদের জন্য কিন্ডারবুকস চালু করি, যাতে তারা গল্প-ছড়ার মাধ্যমে শৈশবেই পড়ার আনন্দ আবিষ্কার করতে পারে। এরপর, বেঙ্গলবুকস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের জন্য নানা ধরনের সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী বই প্রকাশের উদ্যোগ নিই। আমাদের লক্ষ্য শুধু বই প্রকাশ নয়, বরং নতুন লেখক তৈরি করা এবং পাঠকদের মানসম্মত বই উপহার দেওয়া। আমরা চাই আমাদের বইগুলো সর্বত্রগামী হোক।
মানসম্পন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠকের কাছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ‘বেঙ্গলবুকস’ ও ‘কিন্ডারবুকস’ ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে; এটি এত কম সময়ে কীভাবে সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন?
মাহমুদুল হাসান : আমাদের সফলতার মূল কারণ গুণগত মান। আমরা বই প্রকাশে কনটেন্ট নির্বাচনে অত্যন্ত সতর্ক এবং প্রতিটি বইয়ের সম্পাদনা, ডিজাইন ও প্রোডাকশন প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পাশাপাশি, আমরা বাজারে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের বই প্রকাশ করার চেষ্টা করি। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখার বিষয়টিও আমাদের সফলতার অন্যতম কারণ। আরেকটা বিষয়ও বলা দরকার, সেটা হলোÑআপনি খেয়াল করলে দেখবেন, অন্যান্য প্রকাশনীর তুলনায় আমাদের প্রকাশিত বইগুলোর মূল্য অনেক কম। আমাদের শুরু থেকেই চেষ্টা করছি, কম মূল্যে ভালো কোয়ালিটির প্রোডাকশন উপহার দিতে পাঠকদের। সেটাও আমাদের পাঠকপ্রিয়তার একটা বড় কারণ বলে মনে করি।
‘বেঙ্গলবুকস’ প্রধানত কোন ধরনের বই প্রকাশে আগ্রহী?
মাহমুদুল হাসান : বেঙ্গলবুকস মূলত সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, গবেষণা এবং অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহী। আমরা এমন বই প্রকাশ করতে চাই, যা পাঠকের চিন্তার জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে।
আর ‘কিন্ডারবুকস’?
মাহমুদুল হাসান : ‘কিন্ডারবুকস’-এর ক্ষেত্রে আমরা এমন বই নির্বাচন করি, যে বই আমাদের শিশুপাঠকদের কল্পনাকে অবাধ করবে, সেই সঙ্গে তাদের কোমল অনুভূতিগুলোকে সজীব করে তুলবে। আমরা চাই, আমাদের শিশুরা যেন বর্তমান যে ভয়াবহ ডিভাইস-আসক্তি, তা থেকে মুক্ত হয়।
গ্রন্থপ্রকাশ একটি কঠিন প্রক্রিয়া। এটি কীভাবে সম্ভবপর করে তুলেছেন?
মাহমুদুল হাসান : সত্যিই, মানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশ করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু আমরা একটি দক্ষ টিম তৈরি করেছি, যেখানে লেখক, সম্পাদক, কনটেন্ট ডেভেলপার, ডিজাইনার, মার্কেটিং টিম সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করে। আমরা বইয়ের মান ঠিক রাখার জন্য প্রতিটি পর্যায়ে কঠোর পর্যালোচনা করি। আমাদের বইগুলো পুনঃ পুনঃ সম্পাদিত হয়। ততক্ষণ আমরা কোনো পাণ্ডুলিপি মুদ্রণের জন্য প্রেসে পাঠাই না, যতক্ষণ না সম্পাদনা সন্তোষজনক হয়।
‘বেঙ্গলবুকস’ নতুন করে ওয়েস্টার্ন সিরিজ বাজারে আনছে; এটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন?
মাহমুদুল হাসান : ওয়েস্টার্ন সিরিজ বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে একসময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এ সময়ের পাঠকরাও ওয়েস্টার্ন পড়তে চায়। আমরা নতুনভাবে এই সিরিজকে আধুনিক পাঠকের জন্য সাজাচ্ছি, যেখানে কাহিনির গাঁথুনি, অনুবাদ এবং ডিজাইনের দিক থেকে নতুনত্ব আনা হচ্ছে। অগ্রজ ও প্রতিষ্ঠিত ওয়েস্টার্ন লেখকদের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন লিখতে আগ্রহী তরুণ লেখকদেরও আমরা যত্ন সহকারে বই প্রকাশ করছি। আমরা আশা করি, পুরোন পাঠকের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মও এটি উপভোগ করবে এবং প্রায়মৃত বিপুল জনপ্রিয় জনরাটি নতুনভাবে জেগে উঠবে।
‘কিন্ডারবুকস’ ও ‘বেঙ্গলবুকস’ থেকে ভিন্ন ধরনের বই প্রকাশের পরিকল্পনার বিষয়ে যদি একটু জানান!
মাহমুদুল হাসান : আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো নতুন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা, যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হবে। শিশুদের জন্য কিন্ডারবুকস থেকে কল্পবিজ্ঞান, ইতিহাস, ক্লাসিকস এবং শিক্ষামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করছি; আর বেঙ্গলবুকস থেকে নতুন সাহিত্যধারা, গবেষণা ও অনুবাদ বই প্রকাশ করছি। আমাদের লক্ষ্য যেমন বিষয়বৈচিত্র্য, তেমনি কনটেন্টের অথেনটিসিটিও।
কম মূল্যে বই সরবরাহের বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মাহমুদুল হাসান : এটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কারণ আপনি জানেন, গত কয়েক বছরে মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংক্রান্ত উপকরণগুলোর মূল্য শঃনৈ শঃনৈ বেড়েছে। তারপরও বইয়ের দাম সহনীয় রাখার জন্য আমরা কাজ করছি। বইয়ের উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য কৌশল অবলম্বন করছি, যাতে পাঠকরা সহজে মানসম্মত বই কিনতে পারেন।
তরুণ লেখকদের বই প্রকাশে কী ধরনের গুরুত্ব দিয়েছেন?
মাহমুদুল হাসান : তরুণ লেখকদের জন্য আমরা বিশেষভাবে কাজ করছি। নতুন লেখকদের উদ্দেশে নিয়মিত স্ক্রিপ্ট আহ্বান করছি এবং তাদের বই প্রকাশে উৎসাহ দিচ্ছি। তরুণ লেখকরা আমাদের সাহিত্যে নতুন সজীব স্রোতধারা নিয়ে আনবেন। তাদেরকে অবহেলা করলে সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশেরই ক্ষতি।
নতুন লেখক তৈরির বিষয়ে আপনার প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করছে?
মাহমুদুল হাসান : আমরা নতুন লেখকদের প্রশিক্ষণ, সম্পাদনা সহায়তা এবং প্রকাশনার সুযোগ দিচ্ছি, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন। সামনে আরও কিছু পরিকল্পনা আমাদের আছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে আশা করা যায়, একটা নতুন নবীন লেখকশ্রেণি উপহার পাবে জাতি।
গবেষণাধর্মী বই প্রকাশে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
মাহমুদুল হাসান : আমরা গবেষণামূলক বই প্রকাশে আগ্রহী। ইতোমধ্যে কিছু গবেষণা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলছে, যাতে গবেষকদের কাজ প্রকাশ করা যায়। গবেষণার সৃজনশীল দিকগুলো নিয়েও আমরা বই প্রকাশের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছি, যাতে অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে বইগুলো সমান গ্রহণযোগ্যতা পায়।
গবেষণা সেল নির্মাণের বিষয়ে আপনাদের ভাবনা কী?
মাহমুদুল হাসান : আমরা ভবিষ্যতে গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছি, যাতে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে মানসম্মত বই প্রকাশ করা যায়।
ডিজিটাল মাধ্যমে বই প্রকাশের বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
মাহমুদুল হাসান : আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে নজর দিচ্ছি। ই-বুক, অডিও বুক ও ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে পাঠকেরা সহজেই আমাদের বই পড়তে পারেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বই পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের কৌশল আপনারা প্রয়োগ করেন?
মাহমুদুল হাসান : আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও বিক্রয় চ্যানেল সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বই পৌঁছে দেওয়ার। এছাড়া, বিশেষ ছাড় ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বই সহজলভ্য করতে কাজ করছি। আপনাকে তো আগেই বললাম, আমরা চাই, আমাদের বইগুলো সর্বত্রগামী হোক।
‘সাড়ে ৩ দিনের পত্রিকা’ নিয়ে বিস্তারিত বলবেন?
মাহমুদুল হাসান : এটি একটি অভিনব উদ্যোগ, যেখানে বইমেলা চলাকালে প্রতি সপ্তাহে দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে বইয়ের খবর, সাক্ষাৎকার, সাহিত্য বিশ্লেষণ ও পাঠকদের মতামত থাকছে। পত্রিকাটি ইতোমধ্যে তৃতীয় বছর শেষ করে ফেলছে। পাঠকরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন পত্রিকাটিকেÑএটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।