Homeফিকশনঅর্পণ | রফিকুর রশীদ

অর্পণ | রফিকুর রশীদ

অঘটন ঘটল একেবারে পাঁচিল টপকানোর মুহূর্তে এসে। এ-পারে ঠিক যে জায়গাটায় হারুনের দাঁড়ানোর কথা ছিল, সোজা সেদিকে পা বাড়িয়েই পড়ল ফ্যাসাদে। পা নেমেই যাচ্ছে নেমেই যাচ্ছে, থৈ মেলে না কিছুতেই। কোথায় হারুনের কাঁধ? ফটিকের কেমন যেন সন্দেহ হয়Ñ ব্যাবাকটি কাইট্যা পড়ল নি!

কপালের কাছে ডান হাত উঠিয়ে, যেন-বা অন্ধকার চিরে ফাঁক করে নিচে তাকায়। কিছুই চোখে পড়ে না। কারেন্ট আসেনি, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাহস করে আবার পা নামায়। তখনই ধপাস করে পড়ে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার ওঠেÑ কে, কে?

ফটিক বুঝতে পারে হাওয়া উল্টো, পাঁচিলের সঙ্গে ঘেঁষটে যাওয়া কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে সে পালায়। খুঁজতে থাকে সঙ্গী-সাথীদের। হারুন, অমল, বল্টুÑ সবাই হাওয়া হয়ে গেল! মন খারাপ হয়ে যায় ফটিকের। গেল কোথায় ওরা? যদ্দুর মনে পড়ে, না, মোটেই কোকিল ডাকেনি; তার মানে ওরা একটা ইশারা পর্যন্ত দেয়নি। অমল খুব চমৎকার কোকিলের শিস দিতে পারে। সব জায়গায় এ দায়িত্বটা ওরই। বিপদ বুঝে কোকিলের ডাক দেবে। এ রকমই নিয়ম। মল্লিক বাজারে ডাক্তারের বাড়িতে ধরা পড়তে পড়তে ওরা সবাই বেঁচে গেছে অমলের এই কোকিলের ডাকে। তখন অবশ্য গেটের ও-পারে ছিল হারুন। কোকিলের এক ডাকে হারুন এ-পারে।

অমল্যা এইবার কোকিলডাও ডাকাইল না। মন খারাপ করতে করতে এতক্ষণ পর ফটিকের হাত চলে যায় প্যান্টের পকেটে। আবিষ্কার করে একটা তরতাজা গোলাপ। বেশ কিছুক্ষণ থেকেই পকেটের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এই গোলাপের বোঁটায় খোঁচাচ্ছিল। গোটা দুই-তিন পাঁপড়ি ছিঁড়ে গেছে, তবুও কী চমৎকার টাটকা হয়ে আছে। পাঁচিলের বাইরে সে অনেক ফুল চালান করেছে। কিন্তু কী জানি কী লোভে এই গোলাপটা অবলীলায় নিজের পকেটে পুরে ফেলে। এত ফুলের মাঝে এই একটি রক্তগোলাপ ফটিক সেই তখনই আলাদা করে রাখে। এখন হঠাৎ সেটা আবিষ্কার করার পর মনের ভেতর অনেকখানি হালকা হয়ে আসে। বন্ধুদের সবাইকে মুখ খিস্তি করে গালাগালি করার ইচ্ছেটাও পড়ে আসে। এতক্ষণে বরং মনে হয়, হয়তোবা ওরা সত্যিই কোনো কঠিন বিপদে পড়ে গিয়েছিল। এমন হতেও তো পারে। নাকের কাছে গোলাপটা নিয়ে বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় এবং ফটিক এবার বন্ধুদের সবাইকে ক্ষমা করে দেয়।

বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না ফটিকের। শিরশিরে মিষ্টি হাওয়ায় সারারাত হাঁটতে ভালো লাগে। চারদিক ফর্সা হয়ে আসছে। ভোর হতে মোটেও দেরি নেই। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় এক মিছিলের সঙ্গে সে মিশে যায়। খালি পায়ে হাঁটছে সবাই। গলা মিলিয়ে গাইছে গান। কারো হাতে মালা, কারো হাতে ফুলের তোড়া। ফটিকের হাতে সেই তরতাজা গোলাপ। ভারি ভালো লাগে ফটিকের। মনের ভেতরটা সবুজ ঘাসের মতো নরম হয়ে যায়। অমলের কোকিল না ডাকুক, রাস্তার পাশের ঝাকড়া গাছের মাথা থেকে কী একটা ভোরের পাখি ডেকে উঠতেই ফটিকের মন খুশিতে ভরে যায়। পালানোর কথা আর মনেই আসে না। মিছিলের তালে তালে সে দিব্যি এগিয়ে চলে।

শহিদ মিনারের কাছে আসতে আসতে একেবারে ফর্সা হয়ে যায় চারপাশ। ফটিক অবাক চোখে দেখে, মিছিলের পর মিছিল এসে ভরে যাচ্ছে আঙিনা। শহিদ মিনারের বেদিতে সবাই ফুল দিচ্ছে। মিলিত কণ্ঠে গান গাইছে। এত মানুষের ভিড়ে ফটিক আর ফুল দিতে যায় না। সে তার তাজা গোলাপকে আঙুলের ডগায় ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ দৃষ্টি যায় সোজা উত্তরে কৃষ্ণচূড়ার তলায় হারুন অমল বল্টু তিনজনই আছে। ওই দিকটায় তো ভিড় নেই। গাছে হেলান দিয়ে বল্টুকে বিড়ি টানতে দেখে ফটিকের মেজাজটা আবার চিনচিন করে চড়তে থাকে। চট করে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তবু এরই মাঝে এক চিলতে চোখাচোখি হয়ে গেল বল্টুর সঙ্গে। বিড়ির পাছা দেখিয়ে ইশারায় কাছে ডাকে বল্টু। ফটিক ভেতরে ভেতরে গজগজ করেÑ হালায় নবাবের পুত, শুয়ারের নাহাল দাঁত বিছরাইয়া হাসতাছে। সহ্য হয় না ফটিকের। উল্টো দিক ধরে হেঁটে একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে দাঁড়ায়। কোণা ঝোলা পাঞ্জাবি গায়ে এক নেতা বক্তৃতা দিচ্ছে, সেই দিকে তাকায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা তিনজন এসে ঘিরে ধরে ফটিককে। বল্টুই কথা পাড়েÑ তুই দেহি বড্ড ক্ষেইপা গ্যাছস।

ফটিক ওদের দিকে তাকায় না।

এবার হারুন এগিয়ে আসে। দুটো পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে, ল ধর। একটু মশকরা করছি দেইখ্যা তর ভাগের ট্যাহায় ফাঁকি দিই নাই।

একটুখানি ফাঁক দিয়ে অমলের দিকে তাকিয়ে আবারও যোগ দেয়, ব্যাবাকটি ফুল বেইচ্যা চল্লিশ ট্যাহা হইছিল, কী কছরে অমল্যা?

ফটিক কথা বলে না। অমল একটু অন্য সুরে বোঝাতে চায়,

কী রে ফটিক্যা, গোস্বা হইছস? ধর, ট্যাহা ধর। আমরা তো তর ওই গোলাপডার থনে ভাগ চাইতাছি না।

শেষ পর্যন্ত ওরা ফটিকের মুখ খোলাতে না পেরে নিজেদের মধ্যেই আবার মশগুল হয়ে উঠতে চায়। এবার অমলের পিছনে লাগে হারুন, তগো পুজার নাহাল ওই ইটের থাম্বা কয়ডারে হগ্গলে ফুল দ্যায় ক্যান, ক দেহি!

বল্টু ফিক করে হেসে ফেলে। এ প্রশ্নের কেউ কোনো জবাব দেয় না। অমল হঠাৎ আঙুল তুলে পশ্চিম দিকে দেখায়।

ফটিক্যার লুলা বাবা আইতাছে, দ্যাখছস?

ফটিকও ঠিক এই একই সময়ে ওর বাবাকে দেখতে পায়, ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় বক্তৃতা শুনছে। কালো মিনারের ফাঁকে কালিঝুলি মাখা ওই কালো মুখটা কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বলে মনে হয় ফটিকের। দাঁত খিঁচিয়ে ওর বন্ধুদের জবাব দেয়Ñ লুলাবাবা না, ক মুক্তিযোদ্ধা বাবা।

এরপরও বল্টু টিটকারি মারে।

মুক্তির পো মুখ খুলছে রে। চল, কাইট্যা পড়ি। চল।

ওরা সত্যি সত্যি কেটে পড়ে। ফটিক সোজা চলে যায় ওর বাবার কাছে। কোনো রকম ভূমিকা-টুমিকা না করে সোজাসুজি বলে ফেলেÑ এই গোলাপডা আমি চুরি করছি। তয় ট্যাহার লোভে বেচি নাই। হগ্গলেই তো দেহি শহিদ মিনারে ফুল দিতাছে, এইডা আমি তোমারে দেই বাজান। তুমিই লও।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular