রোহানার উদ্দেশ্যে রেলের কম্পার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। কম্পার্টমেন্টে আমার সহযাত্রী একজন মেয়ে। দুজন বয়স্ক, দম্পতিই হবে বোধহয় সঙ্গে এসেছে। মেয়েটির অভিভাবক হবে বোধহয়। ওনারা এসেছে মেয়েকে বিদায় জানাতে। শুনে মনে হচ্ছে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। একা যাত্রাপথে যেন ভয় না পায় সে আশ্বস্তি দেয়ার বিচিত্র প্রচেষ্টা দুজনের। মেয়েটির মা সতর্ক করছেন, আশ্বস্ত করার অভিভাবকসুলভ প্রচেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখছেন না। কিভাবে ব্যাগ সামলে রাখতে হবে, অপরিচিত কিংবা সন্দেহভাজন কারো মুখোমুখি হলে কি করতে হবেুএসব পরামর্শই বেশি। ট্রেন ছাড়ার সময় এলো। মেয়েকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে দুজন কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে পড়েন।
ট্রেন চলতে শুরু করে। আমরা স্টেশন ছাড়িয়ে এগুচ্ছি। আমাকে অন্ধই বলা চলে। চোখ দিয়ে এখন আর কিছু দেখতে পাই না। চোখের সংবেদনশীলতা তাও কিছুটা রয়ে গেছে। অন্ধকার আর আলোর উপস্থিতি ভালোভাবে টের পাই। আফসোস! সামনে থাকা সহযাত্রীর মুখাবয়ব দেখার সুযোগ আমার নেই। তারপরও শব্দ শুনে, ত্বকের স্পর্শে কিছু কিছু অনুমানে পরিপার্শ্ব আন্দাজ করে নেই। এই যেমন কম্পার্টমেন্টে মেয়েটির অস্তিত্বও কানের সংবেদনে যাচাই করছি। কম্পার্টমেন্টে ঢোকার সময় থপ থপ শব্দ পেয়ে বুঝেছি মেয়েটির পায়ে স্লিপার্স। মেয়েটির অস্তিত্ব আমার কাছে এতটুকুই। কথা বললে মেয়েটির রূপ সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। সে চেষ্টা হয়তো করলাম কিন্তু মেয়েটিকে তো পুরোপুরি জানতে পারবো না। তাতে কি আসে যায়। মেয়েটির কণ্ঠও তো ওকে জানার উপায়। ওর স্লিপার্সের শব্দে হাটার গোছানো সতর্কতা অনুমানে বুঝে নিয়েছি। ওর কণ্ঠ আর স্লিপার্সের শব্দ, দুটোই আমার মনে ঠাঁই করে নিয়েছে।
‘যাবেন কোথায়? দেহরা?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
মেয়েটি চমকে ওঠে নাকি! হতে পারে এতক্ষণেও কম্পার্টমেন্টে কোনো সহযাত্রীর উপস্থিতি ওর জানা ছিল না। আমি বোধহয় সিটের এমন কোনে বসে আছি যেখানে অন্ধকার। অন্ধকার আমাকে আড়াল করে ফেলেছে। তাছাড়া আচমকা অপরিচিত কোনো লোকের কণ্ঠ প্রথমবার শুনলে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। মেয়েটি আনমনা কিছুক্ষণ ভাবে। কারণ এখনও প্রশ্নের উত্তর পাইনি। একটু পরই উত্তরের প্রতীক্ষা শেষ হয়, ‘কম্পার্টমেন্টে যে আরও কেউ আছে এতক্ষণ টেরই পেলাম না।’
অবাক হওয়ার কিছু নেই। চাপে বা অস্বস্তিতে ভুগলে সামনে থাকা অনেক কিছুই অদৃশ্য হয়ে পড়ে; তা যত ভালো দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষই হোক না কেন সবারই এমন অভিজ্ঞতা কখনও না কখনো হয়। যারা চোখে দেখে না (কিংবা দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ঝাপসা) তাদের ইন্দ্রিয় আর স্নায়ুর সংবেদনের ওপর নির্ভর করতে হয়।
‘আমিও আপনাকে দেখিনি। শুধু বুঝতে পেরেছি একজন কম্পার্টমেন্টে ঢুকেছেন’
আমি যে অন্ধ তা গোপন করা এবার মুশকিল হয়ে গেছে। ওর বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না।
‘আমি শরণপুর মাসির বাড়ি যাচ্ছি৷ অনেকদিন ধরে মাসি জোর করছিলেন।’
‘আহা! তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ায় লাভ নেই। ঝগড়াটে মাসিদের আমি খুব ভয় পাই।’
‘আপনি কোথায় যাবেন?’
‘প্রথমে দেহরা। তারপর মাসুরি’
‘কি দারুণ! মাসুরির পাহাড়। আসলে পাহাড়ে যেতে আমার ভালোলাগে। মাসুরিতে যেতে পারলেৃআমার এখন ঈর্ষা হচ্ছে। বিশেষত অক্টোবরে গেলে আরও ভালোভাবে উপভোগ করা যায়।’
‘হ্যা, বছরের এই সময়ে ওখানে গেলে ভালো লাগে।’ স্মৃতি হাতড়ে এবার মন্তব্য করতে হয়, ‘পাহাড় এই সময়ে বুনো ডালিয়ায় সেজেগুজে থাকে। চনমনে রোদ স্বাগত জানায় দিনে। আর রাতের নিরবতাও একঘেয়ে লাগে না। রাতে আগুন জ্বালিয়ে চমৎকার সময় কাটানো যায়। বছরের এই সময়ে ট্যুরিস্টদেরও ভিড় থাকেনা। রাতে নিঝুম রাস্তায় হাটলে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এই নিরবতা, এই একাকীত্ব এক ধরনের প্রশান্তি দেয়।’
মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ থাকে। আমার কথা তাকে কতটা প্রভাবিত করেছে বোঝার সুযোগ নেই। হতে পারে আমাকে কল্পনাবিলাশী বোকা ভাবছে।
‘বাইরে তাকিয়েছেন একবারও? কেমন লাগছে?’
আমার প্রশ্নে মেয়েটি অবাক হয়নি! এতক্ষণে তো জেনেই গেছে আমি চোখে দেখিনা। মেয়েটির পরের প্রশ্নে আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়।
‘আপনি বাইরে তাকাননি?’
জানালা পর্যন্ত পৌছুতে কোনো সমস্যা হয় না। আড়ষ্টতা ছাড়াই জানালার কাছে এসে কার্নিশে হাত ঠেকিয়ে বাইরে তাকানোর ভান করি। জানালা আগেই খোলা ছিল। মনোযোগ দিয়ে রেলের ইঞ্জিন আর বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ শুনি। কল্পনায় আদিগন্তের দৃশ্যপট বুনে ফেলা কঠিন কিছু না। চোখে অন্ধকার, তারপরও কল্পনা করি একের পর এক খুঁটি পেছনে সরে যাচ্ছে দ্রুত।
আমি বলি, ‘গাছগুলো দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে। অথচ আমি এখানে ঠাঁই বসে আছি। নড়ছিনা। অদ্ভুত না?’
‘রেলে চড়লে তো এমনই হয়। আপনি বাইরে কোনো পশু-পাখি দেখতে পাচ্ছেন?’
‘নেই।’ আত্নবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেই। দেহরার আশপাশে কোনো পশুপাখি থাকার কথাও না। জানালা থেকে সরে এবার সম্ভবত মেয়েটির মুখোমুখি বসি। দুজন কোনো কথা বলছিনা।
‘আপনার চেহারায় কমনীয়তা আছে।’ সাহস করে বলেই ফেললাম। প্রশংসা করলে মেয়েরা খুশি হয়, অল্প কয়েকজন মেয়েই স্তুতির আকর্ষণ এড়াতে পারে। মেয়েটি হাসে। ওর হাসি রিনরিন সুর তোলে। শুনতে ভালো লাগে।
‘শুনে প্রীত হলাম। তবে একথা অনেকের মুখে শুনেছি। এখন আর এমন প্রশংসা আমাকে নাড়া দেয় না।’
আচ্ছা, তাহলে মেয়েটি সুন্দরীও বটে। ‘কমনীয় মুখ মানে সুন্দরী কেউ, এমনটি বললে ভুল হবে মনে করি না।’
‘আপনার কথা শুনলে বোঝা যায় আপনি সাহসী। কিন্তু কথা বলার সময় অমন সিরিয়াস হয়ে থাকেন কেন?’
উত্তর না দিয়ে হাসলে বোধহয় পরিস্থিতির সঙ্গে বেশি মানাবে। কিন্তু হাসা কি ঠিক হবে? মেয়েটির মুখভঙ্গি যাচাই করতে পারলে আন্দাজ করা যেত। এখন হাসার কথা ভাবলেই অস্বস্তি কাজ করে। কিছুটা নিঃসঙ্গও হয়ে পড়ছি কি!
‘আপনার স্টেশন তো চলে আসছে। অপেক্ষা কমলো।’
‘যাক বাবা। আমার আবার বেশিক্ষণ জার্নি করতে ভালো লাগে না। দুই-তিন ঘন্টা হলে তাও মানা যায়। অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকাৃসহজ না’
অথচ আমি কি-না এখানেই অনিশ্চিত সময়ের জন্য বসে থাকতে রাজি! যতক্ষণ থাকা যায় ততটুকুই। ওর কণ্ঠ শুনতে চাই। যত সময় লাগে লাগুক। আদিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের দিকে তাকালে শান্তির যে অনুভূতি তা মেয়েটির কন্ঠে অনুভব করছি। স্টেশনে রেল থামলেই মেয়েটির সঙ্গে আমার যোগাযোগের ইতি ঘটবে। ও চলে যাবে। কিন্তু এই সময়টা, এই স্বল্প আলোচনার মুহূর্ত ও তার অনুভূতি টিকে থাকবে বহুদিন স্মৃতিতে-মানসপটে; কল্পনাতে।
পরের স্টেশনে থামার প্রস্তুতি রেলচালক নিতে শুরু করেছেন। ইঞ্জিন থামছে, এই প্রচেষ্টায় রেলের ইঞ্জিন থরথর করে কাঁপে। ইঞ্জিনের ধুকপুক শব্দ আমার বুকের ধুকপুকানি শুধু বাড়িয়ে দেয়। স্টেশনে ট্রেন থামে। মেয়েটি বোধহয় তার জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। ওর নড়াচড়া আর পোশাকের খসখসে শব্দ কানে বাজে। মেয়েটির চুল কি বেঁধে রাখা? বিনুনী করা? নাকি খোলাচুলে ট্রেনে চড়েছে? হতে পারে ঘাড় পর্যন্ত চুল ছেটে ফেলা। চুল লম্বা নাকি টমবয় কাট?
স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। কম্পার্টমেন্টের দরজা খোলার পর বাইরে মানুষের কোলাহল পাওয়া যায়। কুলিরা হাকডাক পাড়ছে৷ যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করছে। কম্পার্টমেন্টের দরজার সামনে একজন মহিলা এসে দাঁড়ায়। কণ্ঠ ঝগড়াটে। এমন মোটা স্বরে কথা বলে। মেয়েটি আমার খুব কাছে চলে এসেছে বোধহয়। পারফিউমের ঘ্রাণ স্পষ্ট পাচ্ছি। ও আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘চলি তাহলে। ভালো থাকবেন’
এখানেই ইতি। মেয়েটি নেমে যায়। রেখে যায় পারফিউমের আবছা ঘ্রাণ। পারফিউমের ঘ্রাণ ঘুরপাক খায় আমার চারপাশে। দরজার সামনে হৈহল্লার শব্দ পাই। বোধহয় কারো সঙ্গে অন্য কারো তর্ক চলছে। বাইরের কোলাহলের সঙ্গে আমার এতটুকুই পরিচয়। এক লোক কম্পার্টমেন্টে ঢুকে প্রথমে ক্ষমা চায়। তারপর সশব্দে দরজা আটকে দেয়।
স্টেশনের গার্ড হুইসেল বাজাতেই ট্রেন চলতে শুরু করে। আমি ফের নৈশব্দ্যে ডুবে যাই। তবে সময় কাটানোর এখনও সুযোগ আছে। স্বস্তির বিষয়, আরেকজন সহযাত্রী বাকিটুকু পথে সঙ্গ দেবেন। জানালায় আবার নিজেকে এলিয়ে অযথাই বাইরে তাকাই। বাইরে আলতো রোদ ত্বকের স্পর্শে অনুভব করি, অথচ দৃষ্টিতে সব আঁধার। একটা কাজ করলে হয়না? বাইরে কি আছে তা আন্দাজ করার খেলা খেলে মনকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করতে পারি। আগের স্টেশনে যে লোকটি উঠেছে সে যেচে আলাপ করার চেষ্টা করে, ‘ডিসাপয়েন্ট হয়েছেন বুঝতে পারছি। ডিসাপয়েন্ট হওয়ারি কথা। আপনার আগের সহযাত্রীর মতো ইন্টারেস্টিং আমি নই।’
‘মেয়েটা ইন্টারেস্টিং অবশ্যই।’ আমি মুচকি হেসে উত্তর দেই, ‘একটা কথা বলুন তো। মেয়েটার চুল লম্বা নাকি খাটো?’
‘সেটা বলতে পারছি না। আমি মেয়েটির চুলের দিকে তাকাইনি। ওর চোখ দেখলে আর অন্যদিকে তাকানোর সুযোগও পাবেন না। এত সুন্দর চোখ কারো হতে পারে! কিন্তু লাভ কি? মেয়েটা অন্ধ। বুঝলাম না! আপনি খেয়াল করেননি মেয়েটা অন্ধ?’