Homeআর্ট এন্ড কালচারবাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা পরিস্থিতি | রঞ্জনা বিশ্বাস

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা পরিস্থিতি | রঞ্জনা বিশ্বাস

বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও নানা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বাস করছে। বাংলাদেশের নৃবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা : ভাষা (প্রথম খণ্ড), ২০১৮ অনুসারে বাংলাদেশে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ছাড়া প্রায় ৪০টি ভাষার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। ভাষাগুলো হলোÑ অহমিয়া, বম, চাক, চাকমা, গারো, হাজং, ককবরক, কানপুরী, খাড়িয়া, খাসি, খিয়াং, খুমি, কোচ, কোডা, কোল, কন্দ, কুরুখ, লিঙ্গম, লুসাই, মাদ্রাজি, মাহলে, মালতো, মণিপুরি মৈতৈ, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, মারমা, ম্রো, মুণ্ডারি, নেপালি, ওড়িয়া, পাংখোয়া, লালেং বা পাত্র, রাখাইন, রেংমিৎচা, সাদ্রি, সাঁওতালি, সৌরা, তঞ্চঙ্গ্যা, থর, তেলেগু ও উর্দু। ভাষাগুলো পূর্বমধ্য এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা পরিবারের সদস্য। বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা যেমন বিপন্নতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি জনসংসখ্যার বিচারেও কিছু ভাষা বিপন্নতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ১৪টি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভাষা বিপন্নতার মাত্রা নির্ণয় করার জন্য স্টিফেন ওয়ার্ম পাঁচটি মাত্রায় ভাষার বিপন্নতা পরিমাপের কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ সম্ভাব্য বিপন্ন, বিপন্ন, সংকটপূর্ণভাবে বিপন্ন, প্রায় বিলুপ্ত এবং বিলুপ্ত। সম্ভাব্য বিপন্ন ভাষা হলো, নির্দিষ্ট ভাষার জনগোষ্ঠী যদি বসতি অঞ্চলে বা কর্মক্ষেত্রে ভাষাটি ব্যবহারে বাধাগ্রস্ত হন বা ব্যবহার করতে না পারেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে যদি ভাষাটির প্রচলন না থাকে তবে ধরে নিতে হবে ভাষাটি সম্ভাব্য বিপন্ন ভাষা। বিপন্ন ভাষা হলো নির্দিষ্ট ভাষার জনগোষ্ঠীর মধ্যে তরুণ প্রজন্ম ভাষাটি ব্যবহার করে কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম বা শিশুরা ভাষাটি বলতে চায় না বা শিখতে চায় না। অথবা বাড়িতে বা স্কুলে ভাষাটির ব্যবহার নেই। সংকটপূর্ণভাবে বিপন্ন ভাষা হলো নির্দিষ্ট ভাষার জনগোষ্ঠীর মধ্যে পঞ্চাশ বা তার ওপরে যাদের বয়স তারাই কেবল ভাষাটি বোঝেন এবং বলতে পারেন। সামাজিকভাবে ভাষাটি মূল্যহীন হয়ে গেলে ভাষাটিকে সংকটপূর্ণভাবে বিপন্ন বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রায় বিলুপ্ত হলো, যে ভাষায় খুব অল্পসংখ্যক লোক কথা বলে এবং এই ভাষাভাষীর সদস্যরা খুবই বয়স্ক। এবং বিলুপ্ত ভাষা হলো, যে ভাষার কোনো জীবিত সদস্যরা কেবল মনে করতে পারেন যে তাদের অমুক নামে একটি ভাষা ছিল কিন্তু সেই ভাষার কোনো নমুনা সম্পর্কে তার ধারণা নেই, তাহলে ধরে নিতে হবে ভাষাটি বিলুপ্ত।

তবে বিশ্বে ভাষার অবস্থা বিবেচনার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নিরিখ হলো ‘ফিশম্যান মানদণ্ড’। সেই মানদণ্ডের বিচারে বাংলাদেশের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। একটি ভাষার অবস্থা কী, সেটি বোঝাতে এই মানদণ্ডের আটটি স্তর রয়েছে। চতুর্থ স্তরে থাকলেও ভাষাটি বিপন্ন হিসেবে গণ্য হয় না। কিন্তু পঞ্চম স্তরে চলে গেলে ওই ভাষা বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হবে। ওই মানদণ্ডের প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয় হলো, ভাষাটি ঊর্ধ্বতন সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি হয় না। বাংলাদেশের কোনো আদিবাসী ভাষাই সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় না। এই বিচারে বাংলাদেশে ককবরক, বিষ্ণুপ্রিয়-মণিপুরী, কুরুখ এই তিনটি বিপন্ন ভাষা। বম নিশ্চিতভাবে বিপন্ন ভাষা এবং সাক ভয়াবহভাবে বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে। আর বিলুপ্তপ্রায় ভাষার মধ্যে আছে রেংমিটচা ও সৌরা ভাষা। এ ছাড়া বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিচারে বিপন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে আছে খাড়িয়া, কোডা, মুণ্ডারি, কোল, মালতো, কন্দ, খুমি, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, লালেং/পাত্র ও লুসাই।

বর্তমানে রেংমিটচা ভাষার একক কোনো পরিবার নেই। এই ভাষার যে ৪-৫ জন সদস্য বেঁচে আছেন তারা আলাদা পরিবারে বাস করেন এবং তারা আর এই ভাষায় কথা বলেন না। সৌরাভাষীরা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বাস করে। তারা চা বাগানের শ্রমিক। বাংলাদেশে মোট ৭০টির মতো সৌরা পরিবার আছে বলে জানা যায়। বর্তমানে সৌরাদের প্রায় সবাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশে এ ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই। বাংলাদেশের সিলেট জেলার সদর উপজেলা ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ২৩টি গ্রামে পাত্র সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। পাত্ররা নিজেদের ভাষাকে ‘লালং ভাষা’ বলে। এটি ‘পাত্র ভাষা’ নামেও পরিচিত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পাত্রদের জনসংখ্যা ২০৩৩ জন। তাদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই। গবেষকগণ জানিয়েছেন পাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন অনেক পরিবার আছে যারা ভাষাটা জানলেও এই ভাষায় কথা বলেন না। এই সংখ্যা হবে প্রায় ২ শতাংশ। চল্লিশোর্ধ সদস্যরা লালং ভাষায় কথা বললেও শিশুরা আজ আর এই ভাষা শিখতে চায় না। তাছাড়া বর্তমানে লালং ভাষায় প্রায় ৫০ শতাংশ আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা বিপন্নপ্রায় এই ভাষাটি অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফিশারম্যান স্কেলে পাত্রদের ভাষা আছে বিপন্নতার ষষ্ঠ স্তরে।

মালতো বাংলাদেশে এখন বিলুপ্ত ভাষা। বাংলাদেশে বসবাসরত নাটোর পাবনা রাজশাহী অঞ্চলে মাল পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কিছু দিন আগেও মালতো ভাষায় কথা বলতো। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই ভাষার জনসংখ্যা ছিল ১৮৫৩ জন। বর্তমানে মাল পাহাড়িরা ‘সাদরি’ ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই। মালতো ভাষার মতো বাংলাদেশে রাজওয়ার জনগোষ্ঠীর রাজওয়ার ভাষাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

‘স্লেভ ইন দিস টাইম, টি কমিউনিটি অব বাংলাদেশ’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী বংলাদেশের প্রায় ১২টি উপজেলায়, ৩০টি চা বাগানে প্রায় ৫৩৯টি কন্দ পরিবার বাস করে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকের (সিল) গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের কন্দ ভাষাভাষীদের মধ্যে উড়িয়া ভাষাকে মাতৃভাষা বলেছিলেন ৭৬ শতাংশ মানুষ, যাদের মধ্যে আবার ৪২ শতাংশ সদস্য এই ভাষা ব্যবহার করেন। অন্যদিকে কুইভ ভাষাকে মাতৃভাষা বলেছেন ১১ শতাংশ মানুষ। কিন্তু মাত্র ১ শতাংশের চেয়ে কমসংখ্যক কন্দরা এই ভাষায় কথা বলতে পারে। কন্দদের উড়িয়া ভাষার কোনো বর্ণমালা পাওয়া যায়নি। কুইভ ভাষারও কোনো বর্ণমালা নেই। ফলে কন্দদের এই ভাষা এখন ফিশারম্যান স্কেলে ছয় মাত্রার স্তর অতিক্রম করেছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বিচারে উত্তরবঙ্গে দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী হচ্ছে ওঁরাও। এরা কুঁডুখ ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে ৭৫ হাজার ওঁরাও জনজাতি বসবাস করলেও কুঁডুখ ভাষায় কথা বলতে পারে মাত্র ২৫-৩০ হাজার ওঁরাও। অন্যান্য আদিবাসী ভাষাভাষীর অবস্থা ওঁরাওদের মতোই।

আবার অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা প্রভাবশালী ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে, ফলে বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা এই ভাষা শেখার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় না। কেননা প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক জীবনে ভাষাটির কোনো মর্যাদা সমাজে নেই। ভাষার এই পরিস্থিতি ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষাপ্রেমীদের কাম্য হতে পারে না। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সব ভাষাই সমান গুরুত্বের দাবিদার ও মর্যাদা লাভের অধিকার সংরক্ষণ করে। এ কারণেই ‘আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ’র ৩০ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে : ‘যেসব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে, সেসব দেশে ওই ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত বা আদিবাসী শিশুকে সমাজে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’

ভাষাবিজ্ঞানীরা জানেন ভাষার বিনাশ মানেই হচ্ছে মান সভত্যার বৌদ্ধিক সম্পদের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি। এ জন্য তারা বিপন্ন ভাষা সুরক্ষা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রথমেই ভাষা-নথিবদ্ধকরণের কথা বলেন। এই নথিবদ্ধকরণের জন্য প্রথমেই দরকার ক্ষেত্র সমীক্ষা। যে কাজটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সম্পন্ন করেছে। তারা সেই সমীক্ষার মাধ্যমেই বিপন্ন ভাষার তালিকা প্রণয়ন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, ভাষাগত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ‘মাতৃভাষা পিডিয়া’ নামে একটি কোষগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে যেখানে বাংলাদেশে প্রচলিত, বিপন্ন, বিলুপ্ত সব ভাষা সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। নৃ-ভাষার পুনরুজ্জীবনের জন্য চাকমা, মারমা, গারো, সাদরি ও ত্রিপুরা ভাষার ১৪টি বই বিনামূলে বাংলাদেশ সরকার প্রাইমারির শিশুদের হাতে তুলে দিয়েছে। এতে বিপন্ন ভাষার কথকদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের তাগিদ তৈরি হবে এবং তারা তাদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হবে।

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular