Homeআর্ট এন্ড কালচারএখন পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রচ্ছদ আঁকা হয় কি না সন্দেহ হয় : সমর...

এখন পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রচ্ছদ আঁকা হয় কি না সন্দেহ হয় : সমর মজুমদার

সমর মজুমদার প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত। কাজ করেছেন বাংলার লোকশিল্প নিয়ে। অর্জিত ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যানভাসে। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির নকশা নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। সম্পাদনা করেছেন এ সম্পর্কিত একটি বই। অজস্র ছবি এঁকেছেন পত্রিকা, ম্যাগাজিনের জন্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নুসরাত নুসিন

  • এখন আপনাকে সেভাবে প্রচ্ছদ আঁকতে দেখা যায় না। এর বিশেষ কি কোনো কারণ রয়েছে?

সমর মজুমদার : নিজের ইচ্ছাকে নিজের মতো করে প্রকাশ করব বলে আমি একসময় প্রচ্ছদশিল্প থেকে সরে আসি। এখন ছবি আঁকা নিয়েই থাকি। এটা একটি মহাসমুদ্র। অপার স্বাধীনতা আছে এখানে। আমার নিজের বিষয়, নিজস্ব স্টাইল নিয়ে কাজ করতে পারি। কারও কাছে জবাব দিতে হয় না।

  • আপনি কাজ শুরু করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবীদের সময়ে। নিজস্ব স্টাইল তৈরির চ্যালেঞ্জ নিশ্চয়ই ছিল?

সমর মজুমদার : গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলাদেশের প্রচ্ছদচিত্র অঙ্কনে আমার যাত্রা শুরু। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বই এবং ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ এঁকেছি। সে সময় কয়েকটি বিজ্ঞাপনি সংস্থা এবং হাতে গোনা পত্রিকার বাইরে শিল্পীদের কাজ করার জায়গা ছিল এই প্রকাশনাশিল্পে। প্রচ্ছদশিল্পে তখন কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, প্রাণেশ মণ্ডলদের দুর্দান্ত প্রতাপ। এ সময় আমি ইউপিএল থেকে কথাশিল্পী শওকত আলী স্যারের ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বইটির প্রচ্ছদ করি। পাণ্ডুলিপি পড়ার পর এর কনসেপ্ট নিয়ে, উপস্থাপনা কৌশল নিয়ে ভাবতে থাকি। অপরাপর শিল্পীদের চেয়ে ভালো এবং ব্যতিক্রম না হলে যে এখানে জায়গা পাওয়া যাবে না—কথাটি আমার মাথায় ছিল। প্রচ্ছদ বা যেকোনো ডিজাইন ছাপাখানায় মুদ্রণ তখন সহজ ছিল না। জিঙ্কে ও পাতে ভিন্ন ভিন্ন রঙের জন্য স্বতন্ত্র ব্লক তৈরি করতে হতো। এবং এই করণকৌশল শিল্পীদের জানতে হতো। তবে আমার প্রথম ডিজাইনটি সবার খুব পছন্দ হলো। সেই সুবাদে আমি আরও বেশ কয়েকটি কাজ করার সুযোগ পেলাম। সৌভাগ্যবশত সে বছর শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্প হিসেবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পুরস্কার পেল। আমি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলাম।

  • এখন তো প্রচ্ছদশিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা লক্ষ করছি। নতুন এই পরিস্থিতি কীভাবে মানিয়ে নিলেন?

সমর মজুমদার : মুদ্রণশিল্পে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটেছে। এটা স্বাভাবিক। তখন কিছু পুরাতন অফসেট মেশিন বাংলাদেশে এনে প্রতিস্থাপন করা হয়। ম্যানুয়েল পজিটিভের মাধ্যমে এক রং বা বাই কালারে ডিজাইন ছাপা হতো। এরপর এলো কম্পিউটার। তখনও স্ক্যানার, প্রিন্টার কিছুই আসেনি। এভাবে চড়াই-উৎরাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাবনা-চিন্তার মধ্য দিয়ে কাটে বেশ কিছু বছর। এখন যারা প্রচ্ছদ করেন তাদের এই সমস্যাগুলো ফেস করতে হয়নি। তখন মুদ্রণ অনেক ব্যয়বহুল ছিল। মেশিনম্যানদের অনেকেরই দক্ষতার অভাব ছিল। মুদ্রণের কারণে ডিজাইন কখনও ভালো হতো, কখনও হতো না। মুদ্রণ ভালো না হলে অনেক কষ্ট পেতাম।

  • জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান থেকে শুরু করে আপনি বা বেশ কিছু পরে ধ্রুব এষ—আপনারা প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাবনা ও শিল্পরীতিতে প্রচ্ছদশিল্পকে নতুন একটা মোড় দিয়েছেন। এখন নতুনদের মধ্যে সেই নিরীক্ষা কতটা দেখতে পান?

সমর মজুমদার : এখন যারা প্রচ্ছদ আঁকেন, তাদের অনেকেই ভালো প্রচ্ছদশিল্পী। তবে প্রচ্ছদটি যথাযথ হলো কি না বোঝা যায় বইটি পড়ার পর। এখন পাণ্ডুলিপি পড়ে বা লেখকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রচ্ছদ আঁকা হয় কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়। শিল্পী, লেখক ও প্রকাশককে ফ্যামেলিয়ার হতে হয়। আমি সেই চেষ্টা করেছি যতদিন প্রচ্ছদচিত্র অঙ্কনের মধ্যে ছিলাম। আমি মনে করি না একজন শিল্পী প্রচ্ছদ আঁকার মাধ্যমে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে। এখানে শিল্পীকে কতগুলো শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

  • আপনাকে আলোড়িত করেছে এমন কয়েকটি প্রচ্ছদের নাম জানতে চাই।

সমর মজুমদার : এ মুহূর্তে মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ‘বনলতা সেন’। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘সিনেমা’, যখন ছাপাখানা এলো ‘দাগ’ ইত্যাদি। শিল্পী পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী অঙ্কিত ‘চাঁদনী’ বইটির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের কথা মনে পড়ে। কী এক অসাধারণ যাদুর টান ছিল সেই কাজে! শিল্পী রণেন আয়ন দত্তের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর প্রচ্ছদ, রঘুনাথ গোস্বামীর ‘ক্রীতদাস’, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’, কমলকুমার মজুমদারের ‘আইকম বাইকম’ এর প্রচ্ছদচিত্র এখনও চোখে লেগে আছে। সুকুমার রায়ের বইসমূহ সত্যজিৎ নতুন প্রচ্ছদে করলেন। প্রতিটি অপূর্বই শুধু নয়, যথাযথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিজের অনেকগুলো বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। জয়নুল আবেদিনের আঁকা ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ এর প্রচ্ছদ অপূর্ব! শিল্পী খালেদ চৌধুরীর আঁকা ‘মেঘদূত’ বইটির অপূর্ব অলঙ্করণ আমার চিত্রকলায়ও প্রভাব ফেলেছে।

  • এই সময়ের বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদচিত্রকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সমর মজুমদার : আমি মনে করি প্রচ্ছদচিত্র এমন হতে হয়, যা পাঠককে বই পড়তে টেনে নিয়ে যায়। প্রত্যেক লেখকের প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন। আবার গল্পের, কবিতার, উপন্যাসের, ইতিহাস, বিজ্ঞান বা ধর্মীয় বই হাতে দেখেই যেন এর গোত্র চেনা যায়। বোঝা যায়, এটি প্রচ্ছদচিত্রির প্রথম কাজ। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদচিত্র কেমন তা বোদ্ধা পাঠক, যারা বিভিন্ন ভাষার বই পড়েন, তারা ভেবে নেবেন।

  • রফিকুন নবীকে আপনি বিশেষভাবে পছন্দ করেন। তাঁকে নিয়ে আপনার স্মরণীয় স্মৃতি শুনতে চাই।

সমর মজুমদার : স্যারের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পডে। আমি তখন চারুকলার তৃতীয় বর্ষ অঙ্কন ও চিত্রণ বিভাগে অধ্যয়ন করছি। তখন চারুকলায় এমন পাঠ্যক্রম ছিল, প্রিডিগ্রির দুই বছর সবাইকে সব সাবজেক্ট শিখতে হতো। তৃতীয় বর্ষে নির্বাচিত বিষয় নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন পর্ব শুরু হতো। একদিন ক্লাস করছি, কখন যে স্যার আমার ইজেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন দেখতে পাইনি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি অঙ্কে খুব ভালো ছাত্র ছিলে নাকি? তারপর স্যার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, তোমার কম্পোজিশন খুব ভালো হয়।

  • বাংলা ভাষার আবেগ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনার সঙ্গে শিল্পীসমাজের ভূমিকা থাকে নিশ্চয়ই?

সমর মজুমদার : যে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিগত বছরগুলো আজকের এই মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার একটা বিশাল ভার বহন করতে হয়েছে শিল্পীসমাজকে। শুধু সৃষ্টিই নয়, একটা নতুন দেশকে গড়ার দায়িত্বও ছিল শিল্পীসমাজের হাতে।

 

 

 

Author

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular