সুকুমার বড়ুয়া বাংলাদেশের নন্দিত শিশুসাহিত্যিক। তাঁর লেখার ছন্দকুশলতা, ভাবনা-স্বকীয়তা এবং বিষয়-বৈচিত্র্য পাঠকের মনে মুহূর্তেই আনন্দ সঞ্চার করে। পাগলা ঘোড়া, ভিজে বেড়াল, ঠুসঠাস ছড়াসমগ্র, ১০০ ছড়া-সহ প্রায় ত্রিশটি ছড়াগ্রন্থের রচয়িতা সুকুমার বড়ুয়া বাংলা একাডেমি, অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মজার পড়া ১০০ ছড়া গ্রন্থে শিশু-কিশোরদের মন ছুঁয়ে যাওয়া নির্বাচিত শত ছড়া স্থান পেয়েছে। সাড়ে ৩ দিনের পত্রিকার জন্য গুণী এই ছড়াকুশলীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এহসান হায়দার
প্রায় সাত দশক ধরে লিখছেন। কেমন লাগে নিজের লেখালিখি নিয়ে ভাবতে এতদিন পর?
সুকুমার বড়ুয়া : ভালো লাগে ভাবতে। আমি তো মনের আনন্দে লিখতাম। এখন আর লিখতে পারি না। কারণ, শরীর খারাপ থাকে। এজন্যে মনে যা আসে পাশে কেউ থাকলে লিখে দিতে বলি।
প্রথম লেখা ছাপানোর সময়টা মনে পড়ছে আপনার?
সুকুমার বড়ুয়া : হ্যাঁ, তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা ছিল দৈনিক সংবাদ পত্রিকা। ওই সংবাদ পত্রিকার ‘খেলাঘর’ পাতায় আমার প্রথম ছড়া ছাপা হয়েছিল। সেটা ছিল ভীষণ আনন্দের দিন। সেই লেখাটির কারণে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ পুরস্কার দেয়নি পরে। তখন ওই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন মোট তিনজন। প্রথম ছিলেন নাজমা জেসমীন চৌধুরী, দ্বিতীয় হয়েছিলেন ইমরুল চৌধুরী আর তৃতীয় হয়েছিলাম আমি।
তারপর আপনি ঢাকায় এলেন। কেমন ছিল সেই সময়?
সুকুমার বড়ুয়া : পারিবারিক কারণসহ অন্যান্য নানা কারণ মিলিয়ে আমার লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বলা যায় লিখতে পারিনি। সেটা বছর তিন হবে, জীবিকার চেষ্টাÑআমার জন্য ওই সময়টা দারুণ খারাপ ছিল। আমার ডিপি বড়ুয়া (দেবপ্রিয় বড়ুয়া) এবং ড. কামাল সাহেবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, সেইসূত্রে একটা চতুর্থ শ্রেণির চাকরি পেয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কি! এই চাকরি হওয়ার পরে স্বস্তি তৈরি হলো, স্থির হলাম কিছুটা, এরপরে আমি লেখা শুরু করেছি পুরো মাত্রায়।
ঢাকায় এসে আবার নতুনভাবে লেখা ছাপা হলো?
সুকুমার বড়ুয়া : তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিজানুর রহমান নামে একজন মানুষ ছিলেন। ভদ্রলোক আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার একটি লেখা দৈনিক ইত্তেফাক-এ ছাপা হলো, ছড়াটির নাম ছিল ‘পাগলা ঘোড়া’। এরপর ঘটল মজার ঘটনাÑড. মিজানুর রহমান সাহেব নোটিশ বোর্ডে সাঁটিয়ে দিলেন তা, আর সঙ্গে ইংরেজিতে কী কী লিখলেন ডিপার্টমেন্টের বোর্ডে। আর আমাকে নিয়ে একটা সংবর্ধনার মতো আয়োজন করলেন তিনি। একটা উপহারও পেলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা উপহার দিয়েছিলেন, ওটা এখনো আমার আজিমপুরের বাসায় রয়েছে। সেই থেকেই আমার ফের শুরু হলো লেখার ভুবনে নতুনভাবে যাত্রা।
শিশুরা যখন আপনার ছড়া পাঠ করে, তখন আপনার কেমন অনুভূতি হয়?
সুকুমার বড়ুয়া : ছড়া লেখাটা আমার কাছে একটা মোহনীয় আনন্দ ছিল। এখন আমার ছড়া শিশুরা যখন পাঠ করে, তখন আমার খুব আনন্দ হয়। আমি তো ওদের জন্যই লিখেছি। এখন লিখতে পারি না। হাতে সমস্যা হয়।
প্রথম বই বের হলো কবে, কীভাবেÑবলবেন আমাদের সেই কবেকার কথা?
সুকুমার বড়ুয়া : আমি তখন খুব লিখছি, একদম পুরো মাত্রায় লিখছি। সেই সময়ে পত্রিকার পাতায় আমার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তখন প্রথম বই বের হয়েছিল। ওই বইটা বের করার বিষয়ে মূলত উদ্যোগী হন ড. মিজানুর রহমান সাহেব। তিনিই সব গুছিয়ে দিয়েছিলেন। একটা স্লিপের মতো করে চিঠি লিখে আমাকে আব্দুল হাই সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর আবার আব্দুল হাই সাহেব একটা স্লিপ লিখলেন, সেটা নিয়ে তিনি আমাকে যেতে বললেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের কাছে। এভাবে বাংলা একাডেমি থেকে ‘পাগলা ঘোড়া’ নামে বইটা বের হয় হয়েছিল। আর তারপরে আমার দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে।
আপনার ছেলেবেলার কথা বলবেন?
সুকুমার বড়ুয়া : খুব ছোটবেলায় পড়ালেখার জন্য সৎবোনের বাড়িতে গেলাম। সেখানে ছাগল চরানোর কাজ করতাম। এরমধ্যে আমি আড়াই ক্লাস পর্যন্ত পড়েছি। ক্লাস টু পর্যন্ত বলা যায়। ক্লাস থ্রির বার্ষিক পরীক্ষাটা আমাকে দিতে দেয়নি আমার বোন। ওইখানে থাকার সময় আমাদের স্কুলে একজন ইন্সপেক্টর এলেন, ম্যাডাম আমাকে প্রশ্ন করলেন বেশ কয়েকটি। তখন তিনি আমার মেধা সম্পর্কে ধারণা পেলেন, বুঝতে পারলেন পড়ার আগ্রহটাও। বোনের বাড়িতে অনেক কষ্টে আছি দেখেই আমার মামাবাড়িতে ওরা চিন্তায় পড়লেন। আমার মামা থাকতেন শহরে, ১৯৪৯ সনে শহরে নিয়ে গেলেন আমাকে। একজন মামাত ভাই ছিল। ওখানে ছয় মাস থাকার পরে মামা বদলি হয়ে গেলেন। তাই গ্রামে ফিরে যেতে হলো।
ওখানে কোনো খাবারের ব্যবস্থা নাই। এক মন্দিরের বৌদ্ধ বিক্ষুর কাছে শিষ্যগিরি করতে দিলেন। তিনি ছিলেন অনেক রাগী, আমাকে খুব মারধর করতেন। এখনো মাথায় চিহ্ন আছে স্যান্ডেল দিয়ে বাড়ি দিয়েছিলেন। উনি মারা গেছেন। মামা বললেন, আর একবার মারলে তুমি ওখান থেকে চলে যেয়ো। তারপর একদিন কী কথার জন্য মাইর দিছে, পিঠা বানানোর ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে, তারপর ওখান থেকে চলে গেলাম। এরপর আর সেখানে যাইনি। তারপরে একদিন আর একটা কাজ ঠিক করে দিলেন, বাচ্চা রাখা আর পানি তোলার জন্য ৮ টাকা বেতন দেবে। আমি খুব খুশি হলাম। দেখি ঠিকই ৮ টাকা করে বেতন দেয় নাই, ৩ টাকা করে দিতো। অবশ্য বাচ্চা-কাচ্চাগুলো এত ভালো, দেখা গেল নাচগান করত, আমিও তাদের সঙ্গে মুখস্ত করতাম। একটা বই ছিল আমি তো পড়তে পারি পুরোটা মুখস্ত করে অঙ্গ-ভঙ্গি করে, অভিনয় করে দেখাতাম। বাচ্চারা খুব খুশি হতো। তারপরে ওখান থেকে চলে গিয়েছি। একটা চায়ের দোকানে ১০ মাস চাকরি করলাম, এক টাকা বেতনও দেয়নি। লোকটা অনেক রাগী ছিলÑপালিয়ে বাঁচলাম আর কি! কিছু আনতেও পারিনি পালিয়ে এসেছি। তারপরে একটা দোকানে চা খেয়ে ঝিমোচ্ছি, দোকানদার জিজ্ঞেস করলÑওই মিয়া কী করো। আমার তো কাজকর্ম নাই এই আর কি। বলল যেÑএখানে কাজ করবা? আমি বললাম, ঠিক আছে করব। ওখানে বেশি দিন চলল না। ঘুরতে ঘুরতে ওই বাসায় আবার এলাম। দেখি ওখানে মেস হয়ে গেছে, প্রায় ৫ জন লোক থাকে। একজনে ৩ টাকা করে ভাড়া দেয়। ওরা অফিসে কাজ করত, ওরা চলে গেলে আলমারিতে কতগুলো বই ছিল। ওইগুলো এক এক করে পড়তাম পথের পাঁচালী, কুলি, এরপরে শরৎচন্দ্রের মেজদিদি। কুলি বইটা দারুণ লাগল। আমার জীবনের সাথে যেন মিলে যাচ্ছে কুলি উপন্যাসটা।
যখন আপনি লিখতে শুরু করেনÑতখনকার গল্পটা বলবেন?
সুকুমার বড়ুয়া : আমি তখন মেসে কাজ করি। কাজের ফাঁকে অবসর সময় পেলে পাশের চায়ের দোকানে যাই, ওখানে গিয়ে দৈনিক পত্রিকা পাই, নিয়মিত সংবাদ আর কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা পড়তাম। পড়তে পড়তে একদিন আমার মনে একটা চেতনা জাগল, আমিও এইরকম লিখতে পারব বলে। তারপর একদিন একটা লেখা লিখে পাঠালাম। জবাব দিল যে, লেখাটি ভালো হয়নি আর একটা লিখে পাঠাতে। এরপর ‘বৃষ্টি নেমে আয়’ নামে একটা লিখলাম, ওইটা ছাপা হলো সংবাদ-এ। পড়ে দেখলাম আমি পুরস্কারও পেয়ে গেছি। খুব খুশি, ওখানে তো হৈ চৈ পড়ে গেছে। সকলেই বলছে, আরেহ্, যে রান্না করে বাবুর্চি ছেলে, তার লেখা ছাপা হয়েছেÑআবার পুরস্কারও পেয়েছে, সবাই তাজ্জব হয়ে গেল। ওখানে মাহবুব আলম আছে, মাহবুব আলম সাহেব সবিহ উল আলমের বাবা। উনি জামানা পত্রিকা করতেন। ওনাদের অফিসের মধ্যে আমাকে নিয়ে বেশ আলোচনা হতো। আমি রান্নাবান্না করে কাগজে লিখি, এটা খুব সহজ কথা না। যাই হোক ওখানে আমাকে বলল, ওকে স্কুলে দিলে ভালো হতো। তখন মাহবুবুল আলম সাহেব বললেন, ওকে পড়তে দিবেন নাÑও নিজের মতো করে বেড়ে উঠুক। তারপর উনি একদিন একটা কথা বললেন আমাকে, ‘যখন তুমি রান্না করবা, তখন তুমি একজন রান্নাকর্মী। আর যখন লিখতে বসবা, তখন তুমি পৃথিবীর সব কবির মতো একজন কবি মনে করবা নিজেকে।’
আপনি যখন ঢাকায় এলেন, তখনকার ঢাকার শিশুসাহিত্যিকদের কথা মনে পড়ে?
সুকুমার বড়ুয়া : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রজেক্ট ছিল, ওই প্রজেক্টে ১৯৬২ সালে চাকরিতে যোগ দিলাম। বেতন ৬৪ টাকা। এরপর তো শুরু হলো নতুন জীবন। বলা যায়, শুরু ওখান থেকেই পুনরায়। তখন আমি বিভিন্নরকম লেখা পড়ার সুযোগ পাচ্ছি। নতুন করে সব ভাবতে পারছি। কাজের অবসর নয় কেবল, ছুটির দিনেও পড়ছি। পত্রিকা পড়ার দ্বার নতুনভাবে উন্মোচিত আমার তখন। তখনকার সময়ে অনেকে ছিলেন ঢাকায়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, ওনারা লিখছেন। আখতার হুসেন, রশিদ সিনহা তো মারা গেছেন, মাহমুদুল্লাহসহ আরো অনেকেই ছিলেন। আড্ডা করতেন সকলে এরা। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে বিকালে আড্ডা বসত, আর তখন তো সরকারবিরোধী লেখার একটা চল ছিল, মনে পড়ে ১৯৬৬ সালের দিকে রফিকুন নবীও ছিলেন।
ছড়া লেখার বাইরে কখনও গল্প লিখেছেন?
সুকুমার বড়ুয়ার : গল্প, হ্যাঁÑমাঝে মাঝে লিখেছি। চট্টগ্রাম থাকতেই লিখেছি তিন-চারটি। তারপর ঢাকায় এসে সেই সময়ের পাকিস্তানি খবরেও লিখেছিলাম। এরপর আর লেখা হয়নি। কেবল ছড়াই লিখেছি। ছড়া এসে যায় মনের ভেতর থেকেÑআমাকে টানে আর কি।
মনে পড়ে আপনার কাদের ছড়া?
সুকুমার বড়ুয়া : আমার কাছে মাহমুদউল্লাহ, মোহাম্মদ মোস্তফার লেখা ভালো লাগত। শেষদিকে লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলামের লেখাও ভালো লাগত, পরীক্ষামূলক লেখে এরা। নতুন কিছু করার চেষ্টা ছিল এদের। আলী ইমামও অনেক লিখেছে।
‘শিশুসাহিত্য’ শব্দটি সম্পর্কে আপনার ভাবনা বলবেন?
সুকুমার বড়ুয়া : আমার কাছে সহজভাবে এটাই আসেÑশিশুসাহিত্য বলতে বাচ্চাদের বোধগম্য হতে হবে এটাই বুঝি। সাহিত্য বাচ্চাদের মতো সহজ হতে হবে। যেমন বলতে পারিÑবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড়, পথের পাঁচালী এই বইগুলো তো হাতে পেলে, পড়ে শেষ না করে রাখা যায় না। এই যে এখন চাঁদের পাহাড়কে অন্যরকম করে সিনেমা বানিয়েছে। ওতে ভয় আছে। শিশুরা ভয় নয়, আনন্দ পছন্দ করে, হাসতে ভালোবাসে।